অবিচারের দীর্ঘ এক বছর

কাজী মোঃ হাসান
বৃহস্পতিবার, ৩১ আগস্ট ২০২৩ | ১:৩৪ অপরাহ্ণ

মায়ের সঙ্গে যখনই খাদিজার দেখা হয় তখন মায়ের কাছে মেয়ের আকুতি, ‘মা জামিনের কী করলা’। এমন করুণ আর্তনাদ মাত্র বিশ-একুশ বছরের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া খাদিজার। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরা। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় ২০২২ সালের ২৭শে আগস্ট খাদিজাকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মামলার সময় খাদিজার বয়সও আমলে নেওয়া হয়নি। ২০২০ সালে খাদিজার বিরুদ্ধে মামলার সময় খাদিজার বয়স ছিল ১৭ বছর।

বিশ-একুশ বছরের মেয়েটি দীর্ঘ এক বছর যাবৎ জেলে বন্ধি হয়ে আছেন। তার অপরাধ ছিল একটি ফেসবুক ওয়েবিনার হোস্ট করা, যেখানে একজন অতিথি বক্তা বিতর্কিত মন্তব্য করেছিলেন। অতিথি বক্তা যদি বিতর্কিত বক্তব্য দেয় সে দায় কি সঞ্চালকের? খাদিজার কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত না পাওয়া যায়নি। তারপরও তাকে এভাবে দীর্ঘদিন জেলখানায় বন্ধি করে রাখা হয়েছে।

ইতোমধ্যে, ঢাকার একটি আদালতে খাদিজার জামিন আবেদন কয়েক দফায় নাকচ হয়েছে, বিশ-একুশ বছরের একটি মেয়েকে এই রাষ্ট্রের কিসের এত ভয়? কেউ সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা বা ভিন্নমত পোষণ করলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আওতায় এনে থাকে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর জেলখানায় বন্ধি করে রাখতে হবে কেন? এটি একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হতে পারে? ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এখন অপব্যবহার হচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দোহাই দিয়ে মূলত, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের পাশাপাশি সরকারের সমালোচনা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ করতেই আইনটি তৈরি করা হয়েছে। লেখক মুশতাক আহমেদের, প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামান সহ শত শত সাধারণ মানুষ ও সাংবাদিকদের হয়রানি করা হয়েছে এ আইনের মাধ্যমে।

আইনমন্ত্রী নিজেই তার একটি বক্তব্যে বলেছেন, ‘এই আইনটি এখন অপব্যবহার হচ্ছে।’ ডিএসএ এর অপব্যবহারের মাত্রা যে কত ভয়ংকর, খাদিজার মামলাই তার প্রমাণ। গত জানুয়ারি মাসে সেন্টার ফর গভর্নেসের (সিজিএস) তথ্য অনুযায়ী, ডিএসএ মামলায় ১ হাজার ১১৯ জন আটক হয়েছেন। অনুষ্ঠানে সঞ্চালনার অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীকে মাসের পর মাস কারাগারে আটক রাখা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। এভাবে একজন শিক্ষার্থীর জীবন ধ্বংস করার অধিকার কারও নেই।

খাদিজার পরিবার এখন চরম ভোগান্তিতে শিকার। তার বাবা কুয়েত প্রবাসী। গণমাধ্যমে আমরা দেখেছি তার মায়ের আহাজারি। খাদিজার মা বারবার গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘আমার মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। ওর বন্ধুরা রোজ ভার্সিটিতে যায়, ক্লাস করে, পরীক্ষা দেয়। মেয়ে আমার লেখাপড়া করতে না পেরে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। দিনের পর দিন যদি সে ক্লাস করতে না পারে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ছাত্রত্ব বাতিল হয়ে যায় কি না, সে ব্যাপারেও ভীষণ দুশ্চিন্তা করছে খাদিজা।’

২০১৮ সালে আইনটি জারি করার সময়ই সংবাদমাধ্যমের অংশীজনসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এই আইনের প্রতিবাদ করেছিল। সরকার আমলে নেয়নি। পরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনও এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। প্রতিবাদ করে জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশন, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। সরকার আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নিলেও এই আইন সম্পন্ন বাতিল করা জরুরি এবং এই আইনে যাঁরা গ্রেপ্তার হয়েছেন তাদেরও দ্রুত জামিন দেওয়া প্রয়োজন।

সাধারণ মানুষ এবং সাংবাদিকরা শুরু থেকে এই আইনকে কণ্ঠরোধের হাতিয়ার হিসেবে দেখে আসছে। দেশের ভেতরে ও বাইরে বহু মানবাধিকার সংগঠন আইনটি বাতিলের দাবি জানিয়েছে।

খাদিজার জামিন চেয়ে বিভিন্ন মহল প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাসহ বিভিন্ন সংগঠন খাদিজার জামিনের জন্য আন্দোলন করে আসছে। দীর্ঘ জেলে বন্দি থাকার কারণে খাদিজার পড়াশোনা প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

নতুন আইন ডিএসএ থেকে সিএসএ খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। যা কিনা একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাইবার নিরাপত্তা খসড়ায় ১৮(১)(খ) ২০, ২৩, ২৪, ২৫, ২৬, ২৭, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৬ কে জামিনযোগ্য করা হয়েছে। কিন্তু আগের আইনের সাথে মিল আছে যেমন, ১৭, ১৯, ২৭ অজামিনযোগ্য। এখন পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অজামিনযোগ্য মামলা করা হয়নি। যদি করা হয় সাথে অজামিনযোগ্য আইনের ধারায়ও মামলা করা হয়েছে। তাই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংস্করণ নয় বরং বাদ দেওয়া উচিত।

খাদিজার জামিন নিয়ে এখন পর্যন্ত আদালত কয়েকবার নাচক করেছেন। এভাবে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীর জীবন ধ্বংস করে দেওয়া অমানবিক এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন। তাই যত দ্রুত সম্ভব খাদিজাকে মুক্তি দিয়ে তাকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিন এবং তাকে পুনরায় পড়াশোনা সুযোগ দেওয়া হোক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসেনাবাহিনী কমিশন্ড অফিসার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ২০২৩
পরবর্তী নিবন্ধ২০২৪ সালের ব্যাংক ছুটির তালিকা