নকশি কাঁথার সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণ জরুরি

তোফাজ্জল হোসেন, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
বৃহস্পতিবার, ২৮ অক্টোবর ২০২১ | ১০:০৩ পূর্বাহ্ণ | 238 বার পঠিত

আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী শিল্প নকশি কাঁথা । কারুশিল্পীদের অনবদ্য সৃষ্টি । বাংলার লোকসংস্কৃতি আর গ্রামীণ হস্তশিল্পের একটি বড় জায়গা দখল করে আছে নকশি কাঁথা । বাংলাদেশের শত শত বছরের পুরনো সংস্কৃতির একটি অংশ । এটি বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতেরও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য । যুগ যুগ ধরে এই ঐতিহ্যের গর্বিত ধারক-বাহক বাঙ্গালী শিল্পী মনের নারীরা । সুঁই সুতার সুনিপুণ নকশায় অলঙ্কিত কাঁথাই নকশি কাঁথা । ধারণা করা হয় কাঁথা শব্দটি উৎপত্তি হয়েছে সংস্কৃতি শব্দ কঁথা থেকে । কঁথা শব্দটির বাংলা অর্থ ত্যানা বা কাপড়ের টুকরা । পাঁচশ বছর আগে কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত শ্রী শ্রী চৈতন্য চরিতামৃত বইয়ে কাঁথার কথা সবার প্রথম পাওয়া যায় । অঞ্চল ভেদে বলা হয় কেঁথা, কেথা, ক্যাঁথা, কান্থা, ক্যাতা, কাথা, ক্যাঁতা বা কোন কোন জায়গায় নকশি কাঁথার নাম সাঁজের কাঁথা । ১৯২৯ সালে জসীমউদ্দীনের ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের পর বাংলা ভাষায় নকশী কাঁথা শব্দটির ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয় । পুরো বাংলাদেশেই নকশি কাঁথা তৈরি হয় । বিশেষভাবে ময়মনসিংহ, রাজশাহী, ফরিদপুর ও যশোর নকশি কাঁথার জন্য বিখ্যাত । পাশাপাশি রংপুর, বগুড়া, পাবনা, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও সিলেট অঞ্চলেও তৈরি হচ্ছে এসব কাঁথা । ২০০৮ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য নকশি কাঁথার ভৌগোলিক স্বীকৃতি পায় । লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, সাদাসহ হরেক রঙের নানান সুতায় নকশা করা হয় কাঁথায় । সাধারণত কাঁথা তৈরি হয় পুরনো শাড়ি, লুঙ্গি, ধুতির কয়েক পরতের কাপড় ও লালসালু দিয়ে । এখন বিদেশি সিল্কি পেটি সুতোও ব্যবহার করা হচ্ছে । নকশি কাঁথার জমিন জুড়ে নানান রঙ বাহারী নকশা । যার প্রান্ত জুড়ে থাকে আলাদা আলাদা রঙের নকশার পাড় । সাধারণত কাঁথা সেলাইয়ের কাজ চলে অবসর সময় । বাংলায় দীর্ঘসময় ধরে চলে বর্ষাকাল । বর্ষায় ঘরের বাইরের কাজ কমে আসে নারীদের, একটুখানি অবসরের সন্ধান পায় তারা । বাঙালী নারীদের এই অবসর সময়ে কথপোকথন আর পান সুপারির আড্ডায় সুঁই সুতো হাতে কাঁথা সেলাই এক চিরাচরিত অভ্যাস । পল্লী রমণীদের শিল্পী মনের এক অপূর্ব অভিব্যক্তি যেন নকশী কাঁথা । কোনো সময় কাঁথায় উঠে আসে লুকায়িত ভাবনা, কল্পনা, দুঃখ আর সুখের কাহিনী, মাছ, গাছ, পাখি, পাল্কি, লাঙ্গল, নৌকা, হাতি, ফুল, লতাপাতা, ঘোড়া, চাঁদ-তারা, রাজ-রাজার জীবনকাহিনী, গ্রামীণ জীবনের চিত্র, কখনো লন্ঠণের নিভু আলোয় শোনা পুঁথির গল্পই সূচ দিয়ে কাঁথায় ফুটিয়ে তুলেছেন নারীরা । ব্যবহারিক জীবনে নানা বিষয়বস্তকে কাঁথা সেলাইয়ের এই কারিগররা আর্কষণীয় প্রতীক ও রুপকের আদলে মনের মাধুরী মিশিয়ে ফুঁটিয়ে তোলা বিভিন্ন ফুল, লতা, পাতা ইত্যাদি ঠাঁই দেন তাদের নকশি কাঁথায় । প্রতিটি নকশী কাঁথায় শৈল্পিক, বয়নভুঙ্গির অনবদ্য প্রকাশ ঘটে কেন্দ্রীয়, পৌণিক ও আর্বতক মোটিক সমবায়ে । কাঁটাতারে বাংলা এফোঁড় ওফোঁড় হলেও দুই বাংলাতেই কাঁথা সেলাইয়ের ধরণ আর নকশাও মিল পাওয়া যায়, কারণ বাংলা ভাগ হওয়ার অনেক আগেই এই শিল্পের আবির্ভাব ঘটেছে । তাই বলা হয় নকশি কাঁথা এক একজনের মনের কথা বলে ।

বাংলার প্রবাদ, গান, কাব্য, গাঁথা ও রচনা অমর হয়ে আছে নকশী কাঁথা । ‘ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখা’র মতো বাগধারা রয়েছে । কবি চন্দাবতী তাঁর রামায়ণ কাব্যে সীতার অন্যান্য গুণের সাথে কাঁথা সেলাইয়ের কথা বলেছেন এভাবে, ‘সীতার গুণের কথা কি কহিব আর, কন্থায় আঁকিল কন্যা চান সুরুজ পাহাড় । আরও যে, আঁকিল কন্যা হাসা আর হাসি । চাইরো পাড়ে আঁকে কইন্যা পুষ্প রাশি রাশি’ । এছাড়া পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের অনবদ্য কাব্যগ্রন্থ ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ । এই কাব্য দিয়েই বাংলা সাহিত্যে উঠে এসেছে কীভাবে দৃষ্টি নন্দন সূচের প্রতিটি পরতে পরতে ফুটে উঠতে পারে ভালোবাসা আর বেদনার কাহিনী । প্রেমিক রুপাই আর প্রেমিকা সাজুর ভালোবাসার অমর আখ্যান এই কাব্য । মাঝারি আকারের কাঁথা তৈরিতে ৭ থেকে ১৫ দিন এবং বড় কাঁথা ও জটিল নকশা করতে ১ মাসেরও বেশি সময় লাগতে । আবার কোন কোন কাঁথায় ১ বছর সময়ও লেগে যায় । উনিশ শতকের কিছু কাঁথায় ফোঁড়ের উদ্ভাবনী প্রয়োগকে কুশলতার সাথে ব্যবহার করার ফলে উজ্জ্বল চিত্রযুক্ত নকশা দেখা যায় । ফোঁড়ের বৈচিত্র্য এবং সেই অনুযায়ী একাধিক নাম রয়েছে । পাটি বা চাটাই ফোঁড়, কাঁটা ফোঁড় ও কাইত্যা ফোঁড়াসহ নানা রকমের ফোঁড়ের গুনে নকশা ফোঁটে কাঁথা শিল্পীদের নকশি কাঁথায় । আঁকার ও ব্যবহার ভেদে কাঁথার রয়েছে হরেক নাম । সৃজনী কাঁথা, লেপ কাঁথা, আসন কাঁথা, পারুলি কাঁথা, গাটুরি কাঁথা, আরশী কাঁথা, দস্তর কাঁথা, চাঁদর কাঁথা, রুমাল কাঁথাসহ নানান রকমের কাঁথা বানায় বাঙ্গালী নারীরা । উল্লেখযোগ্য নকশার মধ্যে রয়েছে পদ্ম নকশা, সূর্য নকশা, চন্দ্র নকশা, চাকা নকশা, স্বস্তিকা নকশা, জীবনবৃক্ষ নকশা ও কালকা ও নকশা প্রমুখ ।

পুরুষের পাশাপাশি নারীরা জীবন জীবিকার তাগিদে কর্মক্ষেত্রে অতুলনীয় ভূমিকা রাখছে । অনেকেই নকশী কাঁথা তৈরি করে দারিদ্র্যকে জয় করেছেন ।বাণিজ্যিকভাবে নকশী কাঁথা সেলাই করে সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য ফিরিয়ে এনে অবদান রাখছে দেশের অর্থনীতিতে । এই শিল্প গ্রামীণ নারীদের আয়ের অন্যতম উৎসব । নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারের আর্থিক সাহায্যে ভূমিকা রাখছে বেশ । শৈল্পিক ডিজাইনে প্রতিটি নকশীকাঁথা দেশীয় ঐতিহ্যকে তুলে ধরছে । বর্তমানে নকশী কাঁথাগুলো দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে মন কেড়েছে বিদেশীদেরও । বিদেশে চাহিদা বাড়ছে নকশী কাঁথার । বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, জাপানে নকশী কাঁথার চাহিদা সবচেয়ে বেশি । এছাড়া আমেরিকা, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, সুইডেন, নরওয়ে, জার্মানি, ইতালিসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ছে এই কাঁথা । এছাড়া কারুপণ্য বিক্রির নানা প্রতিষ্ঠান সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার উদ্যোগের মাধ্যমে উৎপাদনে বিপনন নিশ্চিত হওয়ায় নকশি কাঁথা এখন উল্লেখযোগ্য এক হস্তনির্ভর কুটির শিল্প । তবে কালের বিবর্তনে এভাবেই তিলেতিলে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের প্রাচীন হস্তনির্ভর দেশীয় কুটির শিল্প । ফলে, প্রয়োজন সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা, সরকারি প্রণোদনা প্রদান, ব্যবসায়ী পরিকল্পনা ও সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ ও সহযোগিতা । এছাড়াও প্রয়োজন কুটিরশিল্প সম্প্রসারণের জন্য অপেক্ষিত সংরক্ষিত অভ্যন্তরীণ বাজার, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, নকশা বহুমুখীকরণ , ঋণ সুবিধা, বাজারজাতকরণ ও বাজার প্রসারের বিশেষ পদক্ষেপ । নৈপুন্য হস্তশিল্পীদের দৃষ্টি নন্দন এই নকশি কাঁথা আমাদের দেশিয় ঐতিহ্য, আমাদের অহংকার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআজ কলকাতা প্রেসক্লাবে উদ্বোধন হবে ‘বঙ্গবন্ধু সংবাদ কেন্দ্র’
পরবর্তী নিবন্ধফরম পূরণের টাকা ফেরত পাবেন এসএসসি পরীক্ষার্থীরা