পথ হারানো পথ প্রদর্শক, একটি প্রেস স্টিকার এবং গণমাধ্যমের গণ’রা

কাকন রেজা
বুধবার, ০৭ জুলাই ২০২১ | ১:৫৮ পূর্বাহ্ণ

লকডাউনে প্রেস স্টিকার সাঁটা বাইক নিয়ে বেরিয়েছিলেন তিনি। র‌্যাব থামালো, পরিচয়পত্র দেখতে চাইলেন র‌্যাব সদস্যরা। না, কোনো পরিচয়পত্র ছিলো না তার কাছে। এরপর বললেন, তিনি পল্লী চিকিৎসক। কিন্তু মিথ্যা বলার জন্য র‌্যাব সদস্যরা তাকে গাড়িতে তুললেন। পরে জানা গেলো, আটক হয়েছেন স্টিকার সাঁটানো বাইকওয়ালা। রংপুরের লকডাউনের একটা চিত্র এটা। কিন্তু এই চিত্র শুধু লকডাউনেরই নয়, সব ‘ডাউন’ এর। নীতি, নৈতিকতা, পেশাদারিত্ব সব ‘ডাউন’ এর হালচিত্র এমনই।

সাংবাদিকের গাড়িতে প্রেস স্টিকার লাগাতেই হবে এমন শর্ত নেই। আর পরিচয়পত্র সবসময় থাকতেই হবে এমন কথাও নেই। আর সাংবাদিক হলেই তার নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান লাগবে এমন দিব্যিও নেই। ফ্রিল্যান্সার বলে একটি কথা আছে। কেউ যদি যোগ্যতায় নিজেকে প্রমান করতে পারেন, তখন তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। তার কাছ থেকে খবর কিংবা লেখা কিনে নেয় গণমাধ্যম বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। মুশকিল হলো বাংলাদেশে এমন ফ্রিল্যান্সার হওয়ার স্পেসটা খুবই কম। আরে স্পেসের তুলনায় যোগ্য ব্যক্তির সংখ্যাও কম। উন্নত দেশগুলি এমনকি মোদিজি’র ভারতেও ফ্রিল্যান্সার আছেন, যারা যোগ্যতায় উত্তীর্ণ এবং তাদের সেই যোগ্যতার যোগ্য সম্মান দেয়ার মতন প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। যা বাংলাদেশে নেই বললেই চলে।

যাকগে, এখন রংপুরের প্রেস স্টিকার লাগানো সেই সাংবাদিক কাম পল্লী চিকিৎসকের কথায় আসি। সে আটক হয়েছেন এবং হওয়াই উচিত। কারণ সে মিথ্যা বলেছেন। মূলত সে দেখতে বেরিয়েছিলেন লকডাউনটা কেমন হচ্ছে। আর বাইকে প্রেস লেখা স্টিকার তো রয়েছেই, সুতরাং তাকে আর পায় কে। মুশকিলটা এ জায়গাতেই। অনেকে মনে করেন প্রেস লেখা থাকলেই বোধহয় সাত খুন মাফ। আমাদের পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর ধারণাটাও অনেকটা এ রকম। অবশ্য ধারণা না থেকেও উপায় কী। কে আসল, কে নকল বোঝা বড় দায়। আমাদের দেশে যে পরিমান ভুঁইফোড় গণমাধ্যম রয়েছে তা বলতে গেলে নিজেদের ধুতি খুলে যাওয়ার মতন অবস্থা হয়। তাও একেবারে হাটের মাঝখানে।

আচ্ছা সাংবাদিকতা বিষয়টি কি এতই সোজা? প্রেস স্টিকার কিংবা একটা পরিচয়পত্র থাকলেই কি সাংবাদিক হয়ে ওঠা সম্ভব? সম্ভব নয়। সাংবাদিক হতে হলে ‘জ্যাক অব অল ট্রেডস’ হতে হয়। সব কিছুই কিছুটা হলেও জানা থাকতে হয়। পড়াশোনার চর্চাটা থাকতে হয়। বিশ্বে কী ঘটছে সে সম্পর্কে জ্ঞান রাখতে হয়। তার উপর থাকতে হয় লেখার ক্ষমতা। যেটা অনেকটাই ঈশ্বর প্রদত্ত। যাকে মেধা বলে। চেষ্টা করলে হয়তো ভালো করা যায়, সেই ভালো ‘গুড’ থেকে ‘বেটার পর্যন্ত’, কোনো মতেই ‘বেস্ট’ নয়। ভালো করতে হলে ‘বেস্ট’টাই লাগে। সাংবাদিকতা তাই ‘বেস্ট’দের পেশা। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ এমনি এমনিই বলা হয়নি। অতএব স্টিকার বা আইডি কার্ড খুব বেশি অর্থবহ নয়, যদি নিজের যোগ্যতাটা না থাকে।

অনেক বিখ্যাত গণমাধ্যমেও অখ্যাত মানুষজন রয়েছেন। আবার অখ্যাততেও রয়েছেন বিখ্যাতজন। গিয়াস কামাল চৌধুরীর মতন বিখ্যাত সাংবাদিক কম-খ্যাত একটি দৈনিকের সম্পাদনা করতেন। যা তার গড়ে ওঠা নামের সাথে যায় না। আমিও কাজ করেছি সেই কাগজে। গিয়াস কামাল চৌধুরীর জন্যই। তিনিই বলেছিলেন, কাজ করতে।

আমি নিজেও অনেক বিখ্যাত কাগজে লিখেছি, গণমাধ্যমে কাজ করেছি, করছি। আবার কম-খ্যাত গণমাধ্যমেও লিখছি। আমি জানি, কোথায় লিখছি সেটা বড় কথা নয়, কী লিখছি সেটাই বড় কথা। ছোট্ট একটা কথা জানাই ক্ষমা প্রার্থনার সাথে। বিষয়টা অনেকটা ‘জাহিরি’ হয়ে যায়, যা ‘বাতেনি’ থাকার কথা ছিলো, সে জন্যেই আগেই ক্ষমা চেয়ে নেয়া। আমার একই ধরণের দুটি লিখা প্রকাশ পেয়েছিলো দুটি গণমাধ্যমে। একটি বিখ্যাত গণমাধ্যম, আরেকটি কম-খ্যাত। কিন্তু এক সরকারি কর্মকর্তা কথা বললেন সেই কম-খ্যাত মাধ্যমের লিখাটি নিয়ে। পরিচিত বলেই হাসতে হাসতেই ঠাট্টার ছলে বললেন, ‘ভাই আমাদের পেছনে লাগলেন কেন’। এখন এই ‘কেন’ এর ব্যাখ্যা দিই। সেই বিখ্যাত গণমাধ্যমের শব্দসংখ্যা নির্ধারিত করে দেয়া। যার ফলে খুব অল্পতেই লেখাটি সারতে হয়েছে। সেক্ষেত্রে তথ্য, উপাত্ত ও লজিকের ঘাটতি থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু কম-খ্যাত মাধ্যমে লেখা গেছে শব্দসংখ্যা না গুনেই। সঙ্গতই সেখানে ধবল ধোলাইটা বেশি হয়েছে। আর যতটা হয়েছে তাতে ‘কেন’ প্রশ্নটা স্বাভাবিক।

নিজের কথা বাদ দিই। ‘জাহিরি’টা থাক। আসল কথায় আসি। সাংবাদিকতা হলো আত্মনিবেদনের কাজ। ডেডিকেশন আর কমিটমেন্ট মিলেই সাংবাদিকতা। স্টিকার আর আইডি কার্ড মিলে সাংবাদিকতা নয়। অনেকে প্রেস স্টিকারটা বাইকে লাগান সুবিধার জন্য, তাকে কেউ আটকাবে না এ ভেবে। না, আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে ভাবনাটা খুব ভুল নয়। সাধারণত গণমাধ্যমকে সম্মান করার চেষ্টা করেন সবাই। তাই গণমাধ্যমকর্মীদের ছাড় দেয়া হয়। এটা রিয়েলিটি, অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু এই সম্মান আর ছাড়ের সুযোগটাই নেয় একটা টাউট শ্রেণি। চায়ের দোকানদার এই সুযোগটা নিতে সাংবাদিক হয়ে উঠতে চায়। মোটর-মেকানিকের কাছেও পরিচয়পত্র থাকে। ভুল বুঝবেন না, আমি কারো পেশাকে ছোট করছি না। শুধু পেশার জায়গাটা আর পেশাদারিত্বের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছি। এই পরিচয়পত্র দেয়ার সুযোগটা করে দিয়েছে ভুঁইফোড় কিছু গণমাধ্যম। অনলাইন মাধ্যমগুলোই মূলত এর জন্য দায়ী। হালে আবার অনলাইন টিভির দাপটও বেড়েছে। এখন স্টিকারের সাথে যোগ হয়েছে লগো লাগানো বুম। ‘গোদের উপর বিষ ফোঁড়া’ আর কী।
ঘটনাটা বলি, আমার জেলা থেকে পাশের জামালপুর জেলায় যাচ্ছি। ব্রহ্মপুত্র ব্রিজে টোল ঘরের সামনে গাড়ি থামাতে হলো।

ড্রাইভার বললেন, সাংবাদিকদের নাকি টাকা লাগে না। আমি বললাম পচিশ টাকার টোলের জন্য সাংবাদিকতা বেচতে পারবো না, টাকাটা দিয়ে দিন। টোল ঘরের সামনে জ্যাম, গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। এ মুহূর্তে তিনজন নিয়ে একটা বাইক পাশে এসে দাঁড়ালো। সেই তিনের একজন টোল যিনি আদায় করছেন তাকে ডেকে বললেন, ‘ওই আমরা সাংবাদিক’। দেখলাম, ওই টোলের টাকা তোলার লোক রিসিট যে ঘর থেকে দেয়া হয় সেদিকে চিৎকার করে একটা নম্বর উল্লেখ করলো। যে নম্বরটি একটি টেলিভিশনের নামের সাথে মিলে যায়। আমার ড্রাইভারকে বললাম, ওরা তো ওই টিভির কেউ না, তবে টোল আদায়ের লোক ওই নাম বললো কেন? ড্রাইভার জানালেন, ওটা ওদের কোড। ওই সংখ্যা বললে বোঝে গণমাধ্যমের কেউ। অন্যান্য ক্ষেত্রেও এমন কোড রয়েছে। জানি না, ড্রাইভারের কথা সত্যি কিনা। তবে, বুঝলাম স্টিকার আর বুমের জোর আছে। অন্তত পচিশ টাকা তো দিতে হয় না, এটাই বা কম কিসে।

অনেক আগের কথা বলি। ইত্তেফাকের উপদেষ্টা সম্পাদক তখন আখতার উল আলম। তার সাথে গাড়িতে বসা আমি। শেরাটন ছাড়াচ্ছি। গাড়ি জ্যামে। ড্রাইভার চাইলো উল্টো পথে যেতে। আখতার উল আলম সোজা না করে দিলেন। বললেন, জ্যাম ছাড়লেই যাবো। উনাদের মতন মহীরুহের পক্ষেই বোধহয় এমনটা সম্ভব। পরগাছাদের কাছে প্রদর্শনটাই বড় কথা। খবরের ইন্ট্রোটা লিখতে পারে না। এমন কী দুই লাইন শুদ্ধ বাংলা লিখতে বললেও কিবোর্ড বসে যায় কিংবা কলম লজ্জা পায়, এমন পাবলিকও এখন ‘সাংবাদিক’। তাদের হম্বিতম্বিতে আকাশ ভেঙে পড়ে। ‘নাথিং টু ডু, নো-হোয়্যার টু রান’, প্রকৃত সাংবাদিকদের জন্য অবস্থা এমনটাই।

শেষ কথা : এমন অবস্থার জন্য কিন্তু দায়ী প্রকৃত দাবিদার সাংবাদিকেরাই। যাদের কমিটমেন্ট চুলোয় গেছে, ডেডিকেশন শিকায় উঠেছে। মোহমায়া তাদের অন্ধ করেছে। তারা পথ হারিয়েছেন। যারা পথ দেখাবেন তারা পথ হারালে যা হয়, গণমাধ্যমের ‘গণ’দের তাই হয়েছে।

কাকন রেজা : কলাম লেখক ও সাংবাদিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধছাত্র-ছাত্রীদের সুরক্ষার জন্যই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ: শিক্ষামন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধকরোনায় রেকর্ড ২০১ মৃত্যু, শনাক্ত ১১,১৬২