একজন মধ্যবিত্ত বেকার তরুণের গল্প লেখা হয় উপন্যাসের পাতায়, চিত্রায়ণ হয় নাটকের রঙিন ফ্রেমে। ঔপন্যাসিক তাদের উপস্থাপন করেন কখনো হিমু, কখনো ফরহাদ, কখনো ইমন কিংবা বড় ছেলে হিসেবে। রংচটা হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে নগ্ন পায়ে কংক্রিটের রাস্তায় হেঁটে চলা তরুণের নাম হয় হিমু।
আবেগ আর অনুভূতি মিশিয়ে বর্ণনা করা হয় তাদের অগোছালো জীবন গল্প। আবেগ আর অনুভূতিটা যেখানে নিতান্তই সিম্পেথির বাহক হিসেবে কাজ করে যায় রূপাদের মনে। যে রূপাদের সূক্ষ্ম অনুপ্রবেশ হয় নীল শাড়ী, নীল চুড়ি আর মানানসই টিপের সাথে খোলাচুলে কোনো এক ধনকুবের বড় মেয়ে হয়ে যার নাম রূপা নয়তো মীরা!
অতিশয় উৎসাহিত মানুষের মতো তাদের চোখেও প্রথমত অদ্ভুত কোনো প্রাণী বলেই মনে হয় রংচটা হলুদ পাঞ্জাবি গায়ের তরুণটিকে। কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে পার্কের ব্রেঞ্চে গা এলিয়ে উচ্চ শিক্ষিত এক তরুণ নির্বিকার শুয়ে আছে যার পা আবার খালি! এর থেকে আসলে মজার কিছু হয় না! আসলে হয় না বললে ভুল হবে হয়তো হতেই পারে না। আর সেই উৎসুকভাব থেকেই উৎসাহিত প্রেম এবং ক্রমান্বয়ে জটিল রসায়ন। কিন্তু অবশেষ, চাকরির বাজারে নিয়োগ পত্র সংকটের ভীড়ে প্রেমিকার রদবদল।
এতো কেবল উপন্যাসের চরিত্রে এক বেকার তরুণের গড়পড়তা জীবন গল্প। যেখানে প্রেম, আবেগ, অনুভূতি, মায়ার মিশ্রণ জটিলতর। তবে বাস্তবের চিত্রে মধ্যবিত্ত বেকার তরুণের গায়েও এখন চকচকে পোষাক থাকে। সুন্দর একজোড়া জুতো থাকে পায়ে। কেননা একের পর এক ভাইভা বোর্ডে তাদের দৌঁড়াতে হয় শিক্ষাগত সনদপত্র আর জীবনবৃত্তান্তের ফাইল বন্দী খসড়া কপি বগল বাঁধা করে। হয়তো খোঁজ নিয়ে জানা যাবে গায়ের চকচকে পোষাকটাও মেসের তিন বন্ধুর থেকে ধার করে মিলিয়ে পড়ে আসা। কেবল একটাই আশায় হয়তো আজকের ভাইভা তার জন্য শেষ! তারপর সেও শুরু করবে ৮টা – ৪টা যান্ত্রিক জীবনের গল্প। এর মাঝেও কেউ একজন অসীম আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করবে তার জন্যে। আঁচলে ঘর্মাক্ত মুখটা মুছিয়ে দেওয়ার কোনো এক ফাঁকে বলবে,’তোমায় বড্ড ক্লান্ত লাগছে গো। একটু বসো আমি বরফ কুঁচি দিয়ে এক গ্লাস লেবুর শরবত নিয়ে আসছি।’
কিন্তু সেই আসা আর হয় না। এদের কখনো প্রেম হয় না বলেই প্রেমিকা হয় না। যা হয় কেবলই আবেগের হাতছানি নয়তো বেকার তরুণের প্রতি অনুভূতি শূন্য ক্ষণিকের সহানুভূতি। এখনকার রূপাদের বাবারা হিমুর মিথ্যে ইএসপি পাওয়ারে অভিভূত হয় না। তাদের অভিভূত করতে প্রয়োজন হয় গুলশান কিংবা বনানীর ফ্ল্যাট, নিকুঞ্জে দুই কাঠার প্লট সাথে ফরমাল পোশাকের বড় কর্তা হওয়া আবশ্যক। ল্যান্ড ফোনের দিন শেষ হওয়ায় অঞ্জনের আরও বলা হয় না, বেলা প্লিজ আর কিছুটা দিন তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে। বলার আগেই বেলাদের ব্লক লিস্টে জায়গা হয় অঞ্জনের। রদবদলে বেলার পাশে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত দামী গাড়িতে বসে থাকে ব্যাংকার, ব্যবসায়ী কিংবা সরকারের আমলা শ্রেণির কেউ।
ব্যস্ত রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ কোনো একসময় অঞ্জনের সাথে দেখা হয় বেলার। তখনো সে দৌঁড়ায় কেবলই কেবলই দৌঁড়ায়! প্রচন্ড গরমের মাঝেও অসীম ক্লান্তি নিয়ে নগরীর ব্যস্ত ফুটপাত ধরে কখনো বা পিক আওয়ারে বাসের উপচে পড়া দাঁড়ানো যাত্রী হয়ে।
তাই তো এখন আর মধ্যবিত্ত অঞ্জনরা হিমু হয় না। তারা হয়ে যায় চরম অপদার্থ নয়তো পরিবারের বোঝা। পার্কের ব্রেঞ্চিতে গা এলিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে একের পর এক সিগারেটও খায় না তারা। পাঁচ টাকা বাঁচানোর জন্য দুই কিলোমিটার হাঁটে পরবর্তী দিনের ভাইভা দেওয়ার বাস ভাড়ার জন্যে। প্রায়শই অভুক্ত থেকেও গ্রামে থাকা অসুস্থ মা, বৃদ্ধ বাবাকে মোবাইল ফোনের যান্ত্রিক স্বরে বলতে জানে, মা চাকরিটা হয়ে গেছে বাবাকে বলবে মাসের শেষ হলেই টাকাটা পাঠিয়ে দিবো। তোমাকে যেন ভালো ডাক্তার দেখিয়ে নেয়। মা! বাবা ভালো আছে তো? আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না; আমি অনেক ভালো আছি!
তবুও মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বেকার তরুণেরা স্বপ্ন দেখে। তারা স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন নিয়ে বাঁচার আশায়। যখন প্রচন্ড ক্লান্তিতে নিজের শরীরের ওজন আর বইতে ইচ্ছে করে না তখন অসীম নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে বলতে ইচ্ছে হয়, ‘এই তো আছি বেশ, মন্দ নয়!’
লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষার্থী,
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।