সৃষ্টির সুন্দরকে ধ্বংস করছে প্লাস্টিক

সাদিয়া রহমান
শনিবার, ০২ জানুয়ারি ২০২১ | ১১:০৪ অপরাহ্ণ
সৃষ্টির সুন্দরকে ধ্বংস করছে প্লাস্টিক
সাদিয়া রহমান

আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার্য একটি পণ্য ‘প্লাস্টিক’। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই প্রতিদিন অসংখ্য কাজে প্লাস্টিক এর যাচ্ছেতাই ব্যবহার হচ্ছে। প্লাস্টিকের এই একচ্ছত্র ব্যবহার একদিকে যেমন আমাদের পরিবেশের জন্য বড় হুমকি, একই সঙ্গে আশঙ্কার উদ্রেকও ঘটায় ক্রমাগত!

প্লাস্টিক নিয়ে যেকোনো কিছুই লিখার পূর্বে, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্লাস্টিক ব্যবহারের এই একচেটিয়া প্রতিযোগিতার কারণ গুলো প্রথমেই চিহ্নিত করতে হবে। প্রধান কারণ গুলো স্বভাবতই, প্লাস্টিকের স্থায়িত্ব, খরচা কম, সহজ প্রাপ্তি, আকারের ভিন্নতা প্রভৃতি। আর এসব নানামুখী কারণে প্লাস্টিক কাগজের ক্লিপ থেকে মহাকাশযানের বিভিন্ন ধরনের বহুমুখী পণ্যে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

সৃষ্টি মাত্রই তার ভালো ও মন্দ দুটো দিকই রয়েছে। আমাদের সুন্দর এই পৃথিবীর ক্রম বর্ধমান আধুনিকায়নের ফল হিসেবে যতো যুগান্তকারী আবিস্কার বা উদ্ভাবন রয়েছে, সবগুলোরই কিছু না কিছু নেতিবাচক প্রভাবও আমাদের সমাজে সর্বত্র পরিলক্ষিত। প্লাস্টিকের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম মেনে তেমন কিছু নেতিবাচক বিষয় পরিলক্ষিত হচ্ছে।

এক্ষেত্রে বলে নেয়া ভালো, প্লাস্টিক দূষণ হলো পরিবেশ কর্তৃক প্লাস্টিক পদার্থের আহরণ যা পরবর্তীতে যে বন্যপ্রাণ, বন্যপ্রাণ আবাসস্থল, এমনকি মানবজাতীর ওপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে৷ নিয়মিত প্লাস্টিক পদার্থের ব্যবহার প্লাস্টিক দূষণের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে৷ পলিথিন ব্যাগ, কসমেটিক প্লাস্টিক, গৃহস্থালির প্লাস্টিক, বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত প্লাস্টিক পণ্যের বেশিরভাগই পুনঃচক্রায়ন হয় না৷ এগুলো পরিবেশে থেকে বর্জ্যের আকার নেয় এবং দীর্ঘমেয়াদে পরিবেশের ক্ষতিসাধন করে।

সৃষ্টির সুন্দরকে ধ্বংস করছে প্লাস্টিকপ্লাস্টিকের উপর লিখা এই নিবন্ধে একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়! ১৯০৭ সালের ১১ জুলাই। বেলজিয়ামের ৪৩ বছর বয়সী বিজ্ঞানী লিও হেনরিক বায়েকল্যান্ড তখন সবে নতুন এক পদার্থ আবিষ্কার করেছেন। বিজ্ঞানী দারুণ খুশি। একটি জার্নালে নিজের সদ্য উদ্ভাবিত এই পদার্থ নিয়ে গর্ব করেন লিও। তিনি লেখেন, “যদি আমি ভুল না করে থাকি, আমার এই উদ্ভাবন ভবিষ্যতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রমাণিত হবে।”

কিন্তু বিজ্ঞানী তো একজন সামান্য মানুষ ছিলেন। তিনি কীভাবে ভবিষ্যতকে জানবেন? সেদিনের সেই উদ্ভাবনকেই প্লাস্টিক হিসেবে বর্তমানে আমার সবাই চিনি এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারের পাশাপাশি এটিই সবার জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯২০ এবং ৩০ এর দশকেই মূলত প্লাস্টিক ব্যবহার ব্যাপক মাত্রায় সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

আমাদের দেশের ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের কিছু বিষয়ে যথেচ্ছ ব্যবহার দৃশ্যমান হয়। যেমন:

পানির মজুদ: বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের যেকোনো শহরের বাসিন্দাদের জন্যেই পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানির মজুদ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের দেশে সরকারী উদ্যোগে সাধারণ মানুষের জন্য বিশুদ্ধ পানির তেমন কোনো মজুদ বা প্রাপ্তির যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেই। তাই ঢাকা সহ দেশের প্রায় সব ছোট-বড় শহরগুলোতে প্রায়ই আমরা দেখতে পাই, প্রায় সবাই প্লাস্টিকজাত বোতলের বিশুদ্ধ পানির উপর নির্ভর করছে। আর শুধুমাত্র এই একটি বিষয়কে কেন্দ্র করেই প্লাস্টিকের অবাধ বিচরণ গড়ে তোলা সম্ভব! প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ বোতল পানি বিক্রি হয়৷ কিন্তু পানি পান করার পর প্লাস্টিকের ঐ বোতল গুলোর কী হয় তা কি জানেন কেউ? যেহেতু প্লাস্টিক নষ্ট হয়না, তাই সবগুলো প্লাস্টিক বোতলই কোনো না কোনোভাবে পরিবেশ ধ্বংসের কাজ করতে থাকে!

খাদ্য সংরক্ষণ: আমাদের দেশে প্লাস্টিকের আরেকটি যথেচ্ছ ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় খাবার সংরক্ষণ কিংবা ডেলিভারির ক্ষেত্রে। দেশের প্রায় সকল মুদি দোকান, রেস্তোরা কিংবা বেকারীতে, এমনকি আমাদের বাসাবাড়িতেও আমরা খাদ্য সংরক্ষণের জন্য প্লাস্টিকের তৈরী বয়ম, ব্যাগ কিংবা পলিথিনের ব্যবহার দেখতে পাই। দীর্ঘমেয়াদী এসব ব্যবহারে পরিবেশের ক্ষতি সাধিত হচ্ছে।

বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার: বিভিন্ন ধরণের কসমেটিকস পণ্য প্লাস্টিক দ্রব্যে বাজারজাত করণ কিংবা পণ্য বিক্রিতে কাগজের তৈরী ব্যাগের পাশাপাশি প্লাস্টিকের তৈরী শপিং ব্যাগের ব্যবহার-সবই প্লাস্টিকের যথেচ্ছ ব্যবহারের নিদর্শন। প্লাস্টিকের ব্যাগ গুলো একই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী এবং স্বল্প খরচে উৎপাদনশীল হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে বাজার কিংবা দোকান থেকে জিনিসপত্র বহন করার জন্য কিংবা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে এগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে।

খাদ্য দ্রব্যে প্লাস্টিক: করোনা পরিস্থিতিতে আমরা দেখেছি, চা বা কফি পান করার ক্ষেত্রে একবার ব্যবহার করেই ফেলে দেয়া যায় (ওয়ান টাইম কাপ), এমন কাপগুলো প্রচুর পরিমাণে ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া অনেক বছর ধরেই আমরা দেখছি কোনো রেস্টুরেন্ট কিংবা হোটেলে ঠান্ডা পানীয় অর্ডার করলেই তাঁরা পানীয়র সঙ্গে স্ট্র বা পাইপ দিয়ে থাকেন।

আর এভাবেই আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহার্য প্রায় নব্বই শতাংশ প্লাস্টিকই একবার ব্যবহার করে ফেলে দেয়া হয়। বিগত দশ বছরকাল সময়ের পর্যালোচনা করলেই দেখা যাবে, বেশিরভাগ মানুষই প্যাকেজিং এর ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় কিংবা অতিরিক্ত প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার করছেন, যা লম্বা একটি সময় ধরে পরিবেশের তথা পরিবেশে বসবাসকারী প্রতিটি জীবনের ক্ষতি সাধন করছে।

আমরা সকলেই জানি, প্লাস্টিক দূষণ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। বেশিরভাগ প্লাস্টিক ব্যবহারের পর স্থলভাগে (মাটিতে) ফেলা দেয়া হয় এবং দ্রব্যটি মাটিতে না মিশে অনির্দিষ্টকালের জন্য এই পরিবেশেই বিচরণ করে কিংবা স্থলভাগ থেকে অপরিকল্পিত ব্যবস্থার কারণে বৃষ্টির পানির সাথে ভেসে বিভিন্ন পুকুর, ডোবা, নদী-নালা কিংবা সমুদ্রে পৌঁছে যায়।

কেউই সঠিক ভাবে জানেনা যে প্লাস্টিক ভাঙতে কত সময় নেয়, তবে এটি শত বা হাজার বছর সময় নেয় বলে ধারণা করা হয়। এটি কেবল পরিবেশে থাকা বাড়তি বর্জ্যই নয় -বিভিন্ন বিক্রিয়ায় উপস্থিত থেকে বিষাক্ত উপাদান রিলিজ করে, যা আমাদের মাটি এবং পানিকে দূষিত করে।

সূর্যালোক, বাতাস এবং সমুদ্র তরঙ্গের ক্রিয়াকলাপে প্লাস্টিকের বর্জ্য ছোট ছোট কণায় বিভক্ত হয়ে যায় (প্রায় এক ইঞ্চির পাঁচ ভাগের একভাগের চেয়েও কম), যাকে বলা হয় মাইক্রোপ্লাস্টিক। এই তথাকথিত মাইক্রো প্লাস্টিকগুলি পানির স্তর জুড়ে ছড়িয়ে থাকে এবং এভারেস্টের সর্বোচ্চ শিখর থেকে গভীর খাত মারিয়ানা ট্রেঞ্চ পর্যন্ত পৃথিবীর প্রতিটি কোণে প্লাস্টিক পৌঁছে গেছে বলে ধারণা করা যায়। একবার প্লাস্টিকগুলি মাইক্রোপ্লাস্টিকগুলিতে বিভক্ত হয়ে গেলে এবং খোলা সমুদ্রের পানির স্তর জুড়ে প্রবাহিত হয়ে গেলে, সেগুলি পুনরুদ্ধার করা কার্যত অসম্ভব।

মানুষসহ অন্যান্য প্রানীর উপর প্লাস্টিকের প্রভাব: সত্যি বলতে, প্লাস্টিকের উপকারী দিকের পাশাপাশি ক্ষতিকারক দিকের কথাও লিখে শেষ করা সম্ভব নয়।

প্লাস্টিকের প্রভাবে নারী দেহে ইস্ট্রোজেন হরমোনের স্বাভাবিক ক্ষরণ বিঘ্নিত হয়। এছাড়াও শ্বাসকষ্ট, স্থূলতা, স্তন ক্যানসার, হার্ট, লিভার, ফুসফুস ও ত্বকের বিভিন্ন সমস্যায় প্রভাব ফেলে প্লাস্টিক। এমনকি প্লাস্টিকের অসতর্ক ব্যবহারে নবজাতকের জন্মগত ত্রুটি (অটিজম) পর্যন্ত হতে পারে।

প্লাস্টিক প্লাঙ্কটনের মতো ক্ষুদ্র প্রজাতি থেকে শুরু করে বিশাল তিমি পর্যন্ত ফুড চেইনের সমস্ত জীবকে প্রভাবিত করতে পারে। প্লাস্টিক থেকে বের হওয়া টক্সিন গুলো খাদ্য শৃঙ্খলের প্রতিটি পর্যায়ে পৌঁছে যায় এবং আমরা যে মাছ খাই, তাতে পর্যন্ত প্লাস্টিকের উপস্থিতি থাকতে পারে।

গবেষণায় দেখা যায়, প্রতিবছর প্রায় ১০০,০০০ সামুদ্রিক কচ্ছপ এবং অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী শ্বাসরোধ হয়ে মারা যায় শুধুমাত্র প্লাস্টিক বর্জ্যের জন্য। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের মাছ, চিংড়ি এবং ঝিনুক সহ ১০০‘র বেশি জলজ প্রজাতিতে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। প্রচুর দেশি বিদেশি পাখি ইদানিং প্লাস্টিক খেয়ে মারা যাচ্ছে। পাখি থেকে শুরু করে অন্যান্য অসংখ্য জীবজন্তু প্রতি বছর প্লাস্টিকের দূষণের জন্য নিঃশেষ হয়ে যায়। ভ্রহ্মাণ্ডের প্রায় ৭০০ প্রজাতির জীবন প্লাস্টিক দূষণের কারণে শেষ হয়ে গিয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

পরিবেশে উপর প্লাস্টিক প্রভাব: সমাজ জীবনে প্লাস্টিকের দারুণ কদর থাকলেও, এর ব্যবহার পরিবেশের জন্য রীতিমতো হুমকি স্বরূপ। যেমন: একটি গবেষণায় দেখা যায়, এক আউন্স পরিমাণ পলি-ইথিলিন (প্লাস্টিক তৈরির উপাদান) প্রস্তুত করলে, প্রায় ৫ আউন্স পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড বায়ুতে নির্গত হয়। যা বায়ুর জন্য খুবই ক্ষতিকর।

প্লাস্টিকের পণ্য গুলো অপরিশোধিত তেল থেকে তৈরি হয়। অপরিশোধিত তেল থেকে তৈরি হওয়ার অর্থ হল পণ্যটি বায়ো-ডেগ্রেডেবল হয়না, অর্থাৎ সহজে ধ্বংস হবেনা। তাই পরিবেশে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।

সৃষ্টির সুন্দরকে ধ্বংস করছে প্লাস্টিকভূ-ত্বক হতে প্লাস্টিক তৈরির জন্য তেল বা খনিজ পদার্থ নিষ্কাশন করার সময় বিপুল পরিমাণ দূষিত পদার্থের নির্গমন ঘটে। যেমন, কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই অক্সাইড, ওজোন, বেনজিন এবং মিথেন। এসব পদার্থ গ্রিনহাউস প্রক্রিয়ার জন্য দায়ী। এছাড়াও বায়ুতে প্লাস্টিকের আরও অনেক ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে।

প্লাস্টিকজাত দ্রব্য ব্যবহার কমানোর উপায়/বিকল্প ব্যবস্থা: মানুষ মাত্রই বুদ্ধির আধার! এজন্যই মানুষকে প্রাণীকূলের শ্রেষ্ঠ জীব বলে সম্বোধন করা হয়। আমরা সকলেই দিনকে দিন বুঝতে সক্ষম হচ্ছি যে, প্লাস্টিকের ব্যবহার আমাদের জন্য ভয়ানক বিপদের বার্তা এবং এ থেকে পরিত্রাণের উপায়ও আমাদের মনুষ্যকূলকেই বের করতে হবে। তাই অন্তত পক্ষে আমাদের দেশে প্লাস্টিকের বদলে নেয়ার মতো কিছু বিকল্প ব্যবস্থার উপর আলোকপাত করা হলো।

প্লাস্টিক ব্যাগ রোধে পাটের ব্যাপক উৎপাদন এবং প্রক্রিয়াজাত করণ: আমাদের দেশীয় আবহাওয়া এবং মাটি দুটোই পাট উৎপাদনের জন্য ভীষণ রকমের উপযোগী। তাছাড়া আমাদের দেশেই এক সময় প্রচুর পাট উৎপাদন করা হতো। এজন্য পাটকে বাংলাদেশের সোনালী আঁশও বলা হতো। তাই পাটের ব্যাপক উৎপাদন এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে প্লাস্টিক ব্যাগের বিকল্প হিসেবে পাটের তৈরী ব্যাগকে সামনে নিয়ে আসা যেতে পারে।

গবেষণায় দেখা গেছে, ১ হেক্টর জমিতে পাট চাষ করলে যে পরিমাণ পাট চাষ করা যায়, সে সংখ্যক পাট প্রায় ১৫ টন পর্যন্ত কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করতে পারে এবং পাট বেড়ে উঠতে উঠতে পরিবেশে (প্রায় ১০০ দিন) ১১ টন পর্যন্ত অক্সিজেন ছাড়তে পারে।

তাছাড়া পাটের সেলুলোজ মাটির সাথে খুব অল্প সময়েই মিশে যায়, তাই পরিবেশের জন্য এটি খুবই উপযোগী। ইদানিং পাটের সূক্ষ্ম সেলুলোজকে প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি করা হচ্ছে পলিব্যাগ, যা একদমই পরিবেশ দূষণ করে না। এটিকে তাই পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পলিথিনের একটি নির্ভরযোগ্য বিকল্প হিসেবে ভাবা হচ্ছে। রাজধানীর ডেমরার লতিফ বাওয়ানী জুট মিলে পরীক্ষামূলকভাবে স্বল্প পরিমাণে তৈরি হচ্ছে এ পলিমার ব্যাগ।

তবে সারা দেশের জন্য এই পলিমার ব্যাগকে প্রয়োজন অনুযায়ী সরবরাহ করা কিছুটা সময়সাধ্য হবে। ততদিন আমাদেরকে যেসব গুরুত্বপূর্ণ অভ্যাস গড়ে নেয়া উচিৎ তা হলো:

১. পাটের তৈরি সাধারণ ব্যাগগুলোর ব্যবহার: আমাদেরকে পাট থেকে তৈরি সাধারণ ব্যাগগুলো ক্রয়ে আগ্রহী হতে হবে। আমাদের সচেতনতা দেশকে তথা পরিবেশকে প্লাস্টিক হ্রাস করতে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করবে। দেশের মানুষকে পাটজাত দ্রব্যের প্রতি আগের মতো আকৃষ্ট করতে সরকারকে পাটজাত যেকোনো পণ্যের মূল্য হ্রাস করতে হবে এবং অবশ্যই পাটশিল্পের উপর গভীরভাবে গুরুত্ব দেবার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুদ্র ঋণ দানে উদ্যোগী হতে হবে।

২. প্লাস্টিকের ব্যাগগুলো একাধিক ব্যবহার: মুদি দোকান থেকে আনা পলিথিন ব্যাগ কিংবা শপিংমল থেকে আনা প্লাস্টিকের শপিং ব্যাগ গুলি একবার ব্যবহারের পরই নষ্ট হয়ে যায়না। তাই এদেরকে একাধিক বার ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণ করতে হবে এবং এরপর দোকান কিংনা বাজারে যাবার সময় ওগুলোকে অবশ্যই সাথে নিতে হবে যাতে করে কোনো জিনিস বহন করতে দোকান থেকে ব্যাগ না নিতে হয়। আমরা যদি এই অভ্যাস গড়ে তুলতে পারি তবে আমরা অনেকাংশে প্লাস্টিক ব্যাগের অতিরিক্ত ব্যবহার রোধ করতে পারি।

স্ট্র, পানির বোতল এবং অন্যান্য ড্রিংকসের বোতলের বিকল্প ব্যবস্থা: প্লাস্টিকের ব্যাগ গুলোর মতোই, প্লাস্টিকের পানির বোতলগুলো সম্প্রতি জীবনযাত্রার একটি অত্যাবশ্যক অঙ্গ হয়ে উঠেছে, এবং এছাড়াও যখন যেখানে ইচ্ছা ফেলে দেওয়া হচ্ছে। তবে এই ভয়াবহ সমস্যাটি সমাধানে সরকারের কর্তব্যই সবচেয়ে বেশি। যেমন:

১. রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে প্রত্যেক জেলা স্তর পেরিয়ে দেশের প্রতিটি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে (বাস স্ট্যান্ড, শপিংমল,কাঁচা বাজারসহ মানুষজন রোজ আসা যাওয়া করে এমন সকল জায়গায়) নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর পর্যাপ্ত পরিষ্কার সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে আর কখনোই মিনারেল ওয়াটারের দরকার এদেশে পড়বে না।

২. বিভিন্ন ড্রিংকস গুলোর জন্য প্লাস্টিকের বোতলের স্থানে কাচ ও স্টেইনলেস স্টিল বোতল ব্যবহার করে পানীয় বোতলজাত করতে হবে।

৩. স্ট্র ব্যবহারের খুব একটা প্রয়োজনীয়তা নেই। তাই নিজ দায়িত্বে যেকোনো ধরনের পানীয় পানের জন্য স্ট্র ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।

চা, কফি র জন্য বহুল জনপ্রিয় ওয়ান টাইম কাপের বিকল্প ব্যবস্থা: প্লাস্টিকের পাত্রে থাকে “বিসফনল” নামক একধরনের মারাত্মক ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান, যা গরম খাবার বা পানীয়ের সংস্পর্শে এলেই মানব শরীরে প্রবেশ করে ক্ষতি করতে পারে। তাই চা,কফি কাপের বিকল্প ব্যবস্থা একান্তই জরুরী। প্বার্শবর্তী দেশ ভারতে ফুটপাতের দোকানগুলোতে মাটির ভাঁড়ে চা পরিবেশন করতে দেখা যায়। ইদানিং প্রায়ই আমাদের দেশেও অনেক হোটেল, রেস্তোরা কিংবা ফুটপাতের দোকানগুলোতে কিছুটা ভিন্নতা আনতে কিংবা ক্রেতাদের আগ্রহ বাড়াতে মাটির ভাঁড়ে পরিবেশন করা হয় চা/কফি। এই বিষয়টিকেই শখের বসে না করে, স্থায়ীভাবে বেছে নিতে হবে। মাটির ভাঁড় ব্যবহার একটি পরিবেশবান্ধব সমাধান যা করে আমরা সহজেই যেমন নিজেরা রোগ থেকে দূরে থাকতে পারি, তেমনই পরিবেশকেও দূরে রাখতে পারি প্লাস্টিক দূষণ থেকে।

পরিশেষে শুধু বলবো, মানুষ মাত্রই ভুল থেকে শিক্ষা লাভ করে। একটি ভুলকে চিরস্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে অবলম্বন করা যায়না। প্লাস্টিকের ব্যবহার ঠিক এরকমই একটি পন্থা। প্লাস্টিক নিয়ে সারাদিন বসে লিখলেও শেষ করা সম্ভব না। তাই এক্ষেত্রে ব্যক্তিমাত্র নিজে সচেতন হওয়াটা সবচেয়ে বেশি জরুরি।

আমরা তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের নাগরিক। আমাদেরকে তাই অবশ্যই অতি সাবধানতার সঙ্গে সকল বিষয়ে কাজ করতে হবে, যেনো আমাদের দেশকে আমরা একটি আদর্শ মডেল রূপে দাঁড় করাতে পারি। তাই আমাদের উচিত সুনাগরিকের মতো আচরণ করে প্লাস্টিকের যথেচ্ছ ব্যবহার কমিয়ে এনে রাষ্ট্র এবং পরিবেশকে স্বস্তি প্রদান করা। রাষ্ট্র কী করছে, তা জানার আগে, আমি রাষ্ট্রের জন্য কী করছি, সে বিষয়টি মাথায় নিয়ে এলেই উক্ত বিষয়ে পরিত্রাণ সম্ভব।

লেখক: সাদিয়া রহমান, শিক্ষার্থী
এগ্রিকালচার বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৪২৫ টাকায় টিকা কিনবে বাংলাদেশ
পরবর্তী নিবন্ধজাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার শুভেচ্ছা দূত হলেন তাহসান