২২ গজে কি আর দেখা মিলবে মাহমুদুল্লাহর?

রিয়াজুল আমিন রিয়াজ
মঙ্গলবার, ১৫ আগস্ট ২০২৩ | ২:৩৯ পূর্বাহ্ণ | 145 বার পঠিত

দ্যা সাইলেন্ট কিলার খ্যাত ক্রিকেট পাড়ার অতি নম্র-ভদ্র মানুষটি যার নাম মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ, বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং পঞ্চপান্ডবের একজন। বাংলাদেশ ক্রিকেট এখন পর্যন্ত যতজন মহারথীর হাত ধরে সফলতার মুখ দেখেছে তার মধ্যে অন্যতম মহারথী এই ক্রিকেটার। কত যে সুখের স্মৃতি এনে দিয়েছে এই ক্রিকেটার, তাঁর ব্যাটিং নৈপুণ্যে কতবার যে বাংলাদেশের ক্রিকেট পাগল আবেগি মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়েছে তার কোনো হিসেব নেই। কখনো কখনো একাই দলকে টেনে নিয়ে গেছেন, ছিনিয়ে এনেছেন কাঙ্ক্ষিত বিজয়। বীরত্ব দেখিয়েছেন বিশ্বকাপের মঞ্চে। তবে, এই সবই যেন আজ মূল্যাহীন, পরিত্যক্ত ইতিহাস।

মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ এমন একটি মানুষ যার মধ্যে যেন রাগ, মান অভিমান কিছুই নেই। তা নয় কি! দল যখন বিপদে, কিংবা যখন বোলিং ব্যাটিংয়ে বিধ্বস্ত তখন দলকে মহাবিপদ থেকে রক্ষা করতে হাজির হার না মানা এই লড়াকু সৈনিক। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের দুঃসময়ের যখন পরম বন্ধু, তখন একটু সুখের দেখা মিলতেই ছেঁটে ফেলা হলো তাঁকে।

বর্তমানে ক্রিকেট বোর্ড তথা বিসিবি এমন এক পরিস্থিতে উপনীত হয়েছে যেন এই অভিজ্ঞ খেলোয়ারকে তারা কেউ চিনেই না এবং চিনতেও চাই না। প্রতিটি ক্রাইসিস মুমেন্টে অবদান রাখা মাহমুদুল্লাহর ব্যাটিং নৈপুণ্যের কথা ভুলেই গেছেন ক্রিকেট বোর্ড। একইভাবে ভুলে গেছেন, শেষ বলে নিদাহাস ট্রফির সেই মনোমুগ্ধকর ছয় অথবা ২০১৫ বিশ্বকাপে ব্যাক টু ব্যাক সেঞ্চুরি কিংবা নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেই অবিশ্বাস্য ইনিংস। ক্রিকেট বোর্ডের কাছে মাহমুদউল্লাহ ক্রিকেট জীবনের ২৫ বছরের অভিজ্ঞতা, পারফরম্যান্স সবই যেন মূল্যহীন।

নড়াইল এক্সপ্রেস খ্যাত ও বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা এক প্রেস কনাফারেন্সে বলেছিলেন, “মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ কে দেখলে আমার এমনিতেই কেন জানি একটা দূর্বলতা চলে আসে। ছেলেটা চাইলেই ২-৩ এ ব্যাট করে নিজের ক্যারিয়ার উজ্জ্বল করতে পারতো। কিন্তু দেশের জন্য ৭-৮ নাম্বারে খেলতে নামিয়ে দিলেও সে হাসিমুখে মেনে নেয়। তার কোনো আক্ষেপ নেই, অভিযোগ নেই! কয়জন পারে দেশের জন্য এমনভাবে ক্যারিয়ারকে বিসর্জন দিতে?”

তবে কি মুখ বুজে সব সয়ে যাওয়াই কাল হলো মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের জন্য? আসন্ন এশিয়া কাপ দলে না থাকার পরও, মাহমুদউল্লাহ অনুশীলন শেষে কেমন হাসিমাখা মুখ নিয়ে মিরপুর স্টেডিয়াম ছেড়েছেন। বুকে চাপা কষ্ট তবুও মুখে হাসি, নেই কোনো আক্ষেপ বা অভিযোগের বাণী। কয়জন পারে নীরবে নিশ্চুপ থেকে এভাবে সয়ে যেতে?

দেশের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান মি. ডিপেন্ডেবল মুশফিকুর রহিম আক্ষেপের সুরেই বলেছিলেন, “এদেশে অভিজ্ঞতার মূল্য নেই।”একদম যথার্থই বলেছেন তিনি। মুশফিকুর রহিমের এই কথার প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও এশিয়া কাপ ২০২৩ এর দল ঘোষণা যেন এই কথার পরিপূর্ণতা দিয়েছে। বড় বড় টুর্নামেন্টে যে এত সফলতা পেয়েছে এবং সম্প্রতি মাহমুদউল্লাহ, হজ্জ্ব থেকে ফেরার পর থেকে মিরপুর স্টেডিয়ামে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন দলে ফেরার জন্য, দলের হয়ে স্মরণীয় কিছু করবার জন্য, বিসিবি’র ফিটনেস পরীক্ষা পাস করার পরেও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে দল থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

এশিয়া কাপ টুর্নামেন্ট নিশ্চয় খেলোয়াড়দের যাচাই-বাছাই করার মঞ্চ নয়। তারণ্য-নির্ভর, অনভিজ্ঞ ক্রিকেটার নিয়ে দল সাজিয়ে বিসিবি হয়তো এটাই বুঝাতে চাইল যে আমরা এখনও কাপ জয়ের জন্য খেলতে যাই না, কেবল টুর্নামেন্টে অংশ নিতেই যাই। কেবল ডমেস্টিক ক্রিকেটে পারফরম্যান্সের কথা বিবেচনা করে একজন খেলোয়াড়কে এশিয়া কাপের মত বড় মঞ্চ খেলানো কতটা যৌক্তিক সেটা বোধগম্য নয়। জয়ের জন্য দরকার মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের মত ক্রিকেটারদের, যারা মাথা ঠান্ডা করে, চাপ নিয়ে খেলতে পারবে।

মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের জায়গায় যতজন ব্যাটসম্যানকে খেলানো হয়েছে, পরিসংখ্যান বলছে তাদের সকলেই মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের মতো পারফর্ম করতে ব্যর্থ হয়েছে। আর মাহমুদুল্লাহ রিয়াদকে যখন বিশ্রামের নামে বাদ দেওয়া হয়েছে তার ব্যাট তখনও হাস্যোজ্জ্বল। সর্বশেষ দশ ম্যাচে ব্যাটিং গড় ৪৩.৮৭ এবং দুটি হাফ-সেঞ্চুরিও রয়েছে। ২০২১ সাল থেকে ৪৬.৩১ গড়ে ২৭ ম্যাচে করেছেন ৮৮০ রান। বাংলাদেশের কতজন ব্যাটসম্যান এমন ধারাবাহিক রান পায়? আবার অনেকে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের স্ট্রাইক রেইট নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, আপনার দল যখন ব্যাটিং বিপর্যয়ে থাকবে তখন আপনি কি স্ট্রাইক রেইটের দিকে খেয়াল রেখে ব্যাট করবেন নাকি দলের হাল ধরার দিকে নজর দিবেন। দুঃসময়ে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের অবদান আমাদের কারোই অজানা নয়। একজন কিংবদন্তী ক্রিকেটারের ক্যারিয়ার এমন মলিনভাবে শেষ হতে দেওয়া যায় না। আমি বিশ্বাস করি এখনও এই ক্রিকেটারের বাংলাদেশের ক্রিকেটে দেওয়ার মতো অনেক কিছু আছে। খারাপ সময় সব খেলোয়াড়েরই আসে। মাহমুদুল্লাহ রিয়াদেরও এসেছিলো। তাই বলে, এমন একজন ক্রিকেটারকে বিশ্রামের নাম দিয়ে দল থেকে চিরতরে বাদ দিয়ে দেওয়া কোনোভাবেই সমীচীন নয়। স্ট্রাইক রেইট কম মনে হলে তাকে আগে ব্যাট করানো হোক। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ কিন্তু ৪-৫ নং পজিশনেও পরিক্ষিত। মাহমুদউল্লাহ ২০১৫ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপে ৪ নম্বর পজিশনে ব্যাটিং করে ধারাবাহিকভাবে ভালো রান করেছিলেন। সাত নম্বর পজিশনে ব্যাটিং করিয়ে স্ট্রাইক রেইটের অজুহাত দেখিয়ে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে দল থেকে বাদ দেওয়া নিতান্তই অযৌক্তিক।

দলে দীর্ঘদিন খারাপ সময় পার করা ক্রিকেটারদের জায়গা হতে পারলে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের কেন নয়? তবে কি দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্পিনার মোহাম্মদ রফিক দেশের ক্রিকেটকে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিতে বলে ঠিকই পরামর্শ দিয়েছিলেন? যাইহোক সকল বিতর্ককে পাশ কাটিয়ে দেশের ক্রিকেটের স্বার্থে ফিরিয়ে আনুন এই সাইলেন্ট কিলারকে। দেশের ক্রিকেটের কথা ভাবুন, এদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের কথা ভাবুন। আরেকবার সুযোগ দিয়েই দেখুন এই অভিজ্ঞ ক্রিকেটারকে। তার ক্রিকেট মেধার উপর আরেকবার ভরসা করেই দেখুন। আশা করি তা দেশ ও দেশের ক্রিকেটের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনতে পূর্ণ সহায়ক হবে।

ভুলে যাবেন না দেশের প্রকৃত বীরেরা মাহমুদুল্লাহর মতো নীরবে স্বার্থহীনভাবে লড়ে যায় এবং সিক্ত হয় কোটি মানুষের ভালোবাসায়। দু-হাত আকাশপাণে তুলে শূণ্যে লাফিয়ে জয় উদযাপনের জন্য হলেও মাহমুদুল্লাহ রিয়াদকে ২০২৩ বিশ্বকাপে দেখতে চাই। পরিশেষে এটাই বলবো, “ব্রিং ব্যাক মাহমুদুল্লাহ”।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপিএসসি নন ক্যাডার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ২০২৩
পরবর্তী নিবন্ধসেনাবাহিনী কমিশন্ড অফিসার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ২০২৩