হুমায়ূন আহমেদ : যিনি সফল নন স্বার্থক হতে চেয়েছিলেন

কাকন রেজা :
শনিবার, ২৪ জুলাই ২০২১ | ১২:৫০ পূর্বাহ্ণ

বাঙালদের নিয়ে একটা কমন জোকস রয়েছে। জোকসটা হলো, ‘বিদেশীরা যখন দুজনের একটা সুন্দর জুটি দেখে তখন বলে, নাইস কাপল। আর বাঙালদের বেশিরভাগ বলেন, টিকবো না।’ এই যে ‘টিকবো না’ বাক্যটি তা ঈর্ষাপ্রসূত। যাকে ইংরেজিতে বলে ‘জেলাসি’। আর এই ‘জেলাসি’টা এই দেশের বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গনে সবচেয়ে বেশি। নিজেকে উঁচু ও অন্যকে খাটো করতে এ দেশে নানান উদ্ভট কাজকম্মো চলে। তালিকা বিষয়টা তার একটি। আমাদের দেশে নানা বিষয়ে তালিকা করা হয়। বুদ্ধিজীবীর তালিকা। কবির তালিকা। কমেডিয়ানের তালিকা। ‘সেরা বাহাত্তুর’ টাইপ আর কী। যা ‘জেলাসি’রই একধরণের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া।

চুয়াডাঙায় জন্ম নেয়া কবি রিগ্যান এসকান্দার ফেসবুকে লিখলেন, চুয়াডাঙার এক’শ কবির তালিকায় তিনি নেই। সম্প্রতি কবিদের প্রণোদনা দেয়ার লিস্টেও তার প্রতিফলন ঘটেছে। যাদের কবি স্বীকৃতি পাওয়ার কথা তাদের নাম নেই তালিকায়। প্রণোদনা পেয়েছেন আরেকজন। এ অবশ্য নতুন কিছু নয়। সেদিন খবরে দেখলাম অবিবাহিতা মেয়েও বিধবা ভাতা তুলছেন। আর মুক্তিযোদ্ধা তালিকার ক্যাচাল তো সবার জানা। ভুয়া তালিকায়, সার্টিফিকেটে সচিবও হয়েছেন কেউ কেউ। সুতরাং তালিকা নিয়ে লেখা বা দুঃখ করার কিছু নেই। যেখানে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরেও মুক্তিযোদ্ধার তালিকা সংশোধন করতে হয়।

‘জেলাসি’র কথায় ফিরি। হুমায়ূন আহমেদের প্রয়াণের দিন ছিলো ১৯ জুলাই। অনেকেই তাকে স্মরণ করেছেন। সেই স্মরণ নিয়েও বাঁকা কথা হয়েছে! এ দেশে এমনটাই হয়। কম ধারণার কথা বলছি না, বাংলাদেশের সাহিত্য সম্পর্কে যার ভালো ধারণা রয়েছে তার পক্ষে হুমায়ূন আহমদেকে অস্বীকার করার জো নেই। কিন্তু তাদের অনেকেই করেন। সোজা ভাষায় তার কারণ হলো সেই ‘জেলাসি’। হুমায়ূন আহমেদের আগে-পরে অনেকেই প্রয়াত হয়েছেন। কিন্তু হুমায়ূনের প্রয়াণের সাথে তার তুলনা চলে না। একজন লেখক কী পরিমান মানুষের কাছাকাছি গিয়েছিলেন তার প্রমান হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর শোকাহত মানুষের ঢেউ। তার অন্তিম যাত্রায় মানুষের অংশগ্রহণ জানিয়ে দিয়েছিলো, হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যিনি সকল এলিটিজমে’র ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের অংশ হয়ে গিয়েছিলেন। সাহিত্যে এরচেয়ে বড় স্বার্থকতা আর কিছুতে নেই। থাকা উচিত নয়। সাহিত্যের তথাকথিত এলিটরা তার কাছে নস্যি। সে হোক হুমায়ুন আজাদ, সৈয়দ হক কিংবা অন্য কোনো কেউকেটা।

জানি, সাহিত্যে অদ্ভুত টাইপ এলিটিজমের ধারণা সম্পর্কিত ব্যক্তিগণ হুমায়ূন আহমেদকে জনপ্রিয় আখ্যা দিয়ে নিম-লেখক প্রমাণ করতে চান। এটাও তাদের ‘জেলাসি’ বৃক্ষের তেতো ফল। কারণ হুমায়ূন আহমেদ গল্প বলার যে অসাধারণ ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিলেন, তার কালের কিংবা আগের কালের কারোর মধ্যে তা ছিলো না। রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’ মোহাবিস্ট করেছিলো শহুরে বা আধা শহুরে রোমান্টিসিজমে ভোগা পুতুপুতু মধ্যবিত্তদের। আর কারো উদাহরণ টানলাম না, সাহিত্যে আধিপত্যবাদীদের গুরু রবি ঠাকুরের স্মরণ নিলাম। বলবেন, হুমায়ূন আহমেদ তো রবীন্দ্রনাথকে অসম্ভব পছন্দ করতেন। করতেন, তাতে কি? রবীন্দ্রনাথকে আমাকেও পছন্দ করতে হবে? কিংবা পছন্দ করলেও তার সমালোচনা করতে পারবো না কেন! এখানে ‘না পারা’র কথাটিই সাহিত্যের আধিপত্যবাদ। জোর করে মানানোর চেষ্টাই হলো আধিপত্যবাদ এবং জোর করে না মানানো সাথে হুমায়ূন আহমেদকে অস্বীকার করার চেষ্টাটাও তাই। আর এই আধিপত্যবাদ রাজনীতি প্রসবিত। সেটা অন্য আলাপ আরেকদিনের জন্য তোলা রইলো। হুমায়ূন আহমেদ কিন্তু রবীন্দ্রনাথকেও ছাড়েননি। স্যাটায়ারে তিনি ছিলেন প্রবাদতুল্য।

অনেকে গম্ভীর গলায় বলেন, আমি বোদ্ধাদের জন্য লিখি। সেটা তার ইচ্ছা। অনেকে শিশুসাহিত্য করেন। কারণ শিশুদের সাহিত্য বোঝা দরকার। কিন্তু বোদ্ধারা তো বোঝেন, তাদের আর বোঝাবার দরকার কী! বোঝানোর দরকার সাধারণদের। আর সেই কারণেই স্বার্থক লেখক তারাই যারা অনেক বড় জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছাতে পারেন। যে জনগোষ্ঠীর মধ্যে বোদ্ধা থেকে নিতান্ত আটপৌরে মানুষ সবাই রয়েছেন। হুমায়ূন আহমেদ পেরেছিলেন। যে কারণে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র মানুষের মাঝে পৌঁছানোর জন্য ভ্রাম্যমান লাইব্রেরি করেছে। যদি বোদ্ধাদের জন্য শুধু সাহিত্য বা জ্ঞানচর্চা হতো তাহলে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিই যথেষ্ট ছিলো।
কাগজের ‘আলোচনা’, টিভির টকশো বা অনুষ্ঠানে ডাক কোনো লেখককে সফল করতে পারে স্বার্থক করতে পারে না। এখন প্রশ্ন হলো আমাদের সাহিত্যিকরা সফল হতে চান, না স্বার্থক হতে চান। লক্ষণে তো সফলতার ব্যাপারটিই চলে আসে। পদক আর পুরস্কারের জন্য কবি-সাহিত্যিকদের যে পরিমান দৌড়-ঝাপ আর আক্ষেপ-আহাজারি দেখি তাতে তো তাই মনে হয়। তাদের সফলতার দিকেই ঝোঁক বেশি। মনি-কাঞ্চনের লোভ জয় করতে পারা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয়নি।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্বার্থকতার কথাই বলেছেন বারবার। আলোকিত মানুষ বলতে তিনি স্বার্থকদেরই বুঝিয়েছেন। যারা আলো বিলাতে পারেন। সফলদের আলো বিলানোর ক্ষমতা নেই, আহরণের রয়েছে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সেই স্বার্থকতার অংশ হলো মনি-কাঞ্চনের লোভ জয় করা। অথচ তার গড়া প্রতিষ্ঠানেই সফলদের ভীড়। তার চারিপার্শ্বে সফলদের ‘খমা’ মানে চেহারাই দৃশ্যমান সব জায়গাতে। যা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের নিজের পুরোপুরি স্বার্থক হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা।

হুমায়ূন আহমেদ দিয়েই হুমায়ূন আহমেদের কথা শেষ করি। ‘জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল হাইস্কুল’ এর উৎসর্গপত্রে তিনি লিখলেন-
সাজ্জাদ শরীফ ভাই, বঙ্গদেশীয় ‘ইনটেলেকচুয়েলদের’ ব্যাপারে আমার এলার্জি আছে। এদের সহ্য হয় না। আপনাকে কেন সহ্য হল এবং সহ্য হতে হতে কেন পছন্দ হয়ে গেল- বুঝতে পারছি না। আমার পছন্দের ব্যাপারটি কাগজ পত্রে থাকুক এই ভেবেই উৎসর্গ লিপি।

পুনশ্চ : প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ বঙ্গদেশীয় ‘ইনটেলেকচুয়েলদের’ বিষয়ে আমারও অ্যালার্জি আছে। এতবেশি চুলকায় তারা সহ্য করা সত্যিই কঠিন। সেই অ্যালার্জির বিষয়টি কাগজপত্রে থাকুক ভেবেই এমনটা লিখা।

কাকন রেজা : লেখক ও সাংবাদিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধগণসংগীত শিল্পী ফকির আলমগীর আর নেই
পরবর্তী নিবন্ধজমজ সন্তান জন্মের পর মারা গেলেন পাবিপ্রবি ছাত্রী