পবিত্র হজের দোয়া ও ফজিলত

এমসি রিপোর্ট
শুক্রবার, ০৮ জুলাই ২০২২ | ১:৩৮ পূর্বাহ্ণ
সীমিত পরিসরে পবিত্র হজ আজ
ফাইল ছবি

হজ ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম। হজে আর্থিক ও কায়িক শ্রমের সমন্বয় রয়েছে। পবিত্র হজের দোয়া ও ফজিলত অনেক। অন্য কোনো ইবাদতে হজের মতো এই দুইটি একসঙ্গে পাওয়া না যায় না। মহান রাব্বুল আলামিন সামর্থ্যবান প্রতিটি মুসলিমের উপর দ্রুত হজ সম্পাদন করা ফরজ করেছেন। ইসলামে হজের দোয়া ও ফজিলত যথেষ্ট।

হজ মুসলিম উম্মাহর গর্ব। নানা জাতি ও বর্ণের মুসলিমদের ঐক্য ও সাম্যের প্রতীক। প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৩০ থেকে ৪০ লাখ মানুষ পবিত্র হজ পালনে সৌদি গমন করেন। অগণিত কিংবা নির্ধারিত— যত সংখ্যক হাজি-ই সেখানে যান, তারা আল্লাহপ্রেমের পাঠ চুকিয়ে রাসূলপ্রেমের মশগুল থাকেন। মহা সৌভাগ্য ও পূণ্যের মিছিলে নিজেদের নাম লেখান।

হজ ও ওমরাহ কী?

স্বাভাবিকভাবে ‘হজ’ অর্থ মহৎ কাজের ইচ্ছে করা। পারিভাষিকভাবে হজ বলে, হজের নিয়তসহ ইহরাম ধারণ করে— নির্দিষ্ট দিনে আরাফার ময়দানে অবস্থান করা ও কাবা শরিফ তাওয়াফ করা। (ফাতাওয়া শামি, খণ্ড : ০২, পৃষ্ঠা : ৪৫৪)

আর ‘ওমরাহ’ অর্থ পরিদর্শন করা। ওমরাহর নিয়তে ইহরাম ধারণ করা, এরপর তাওয়াফ ও সাঈ করে মাথা মুণ্ডন করে ইহরামমুক্ত হওয়াকে ওমরাহ বলে। (ফাতহুল বারি, খণ্ড: ০৩, পৃষ্ঠা: ৫৯৭)

হজের সওয়াব ও ফজিলত

আল্লাহর রাসুল (সা.) হাদিসে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজ করে এবং অশ্লীল ও গুনাহর কাজ থেকে বেঁচে থাকে, সে নবজাতক শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে যায়। আর মকবুল হজের পুরস্কার জান্নাত ছাড়া অন্য কিছুই নয়।’ (বুখারি, খণ্ড: ০১, পৃষ্ঠা: ২০৬)

ওমরাহ ও হজ অভাব দূর করে

আল্লাহর রাসুল (স.) বলেন, ‘তোমরা হজ-ওমরা সঙ্গে সঙ্গে করো। কেননা, এ দুটি দারিদ্র্য ও গোনাহ এভাবে দূর করে, যেভাবে হাঁপর লোহা ও সোনা-রুপার ময়লা দূর করে। আর মকবুল হজের বিনিময় জান্নাত।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৮৮৭)

ইসলামে হজের দোয়া ও ফজিলত

হজের বিনিময় জান্নাত

আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন- ‘এক উমরা আরেক উমরা পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহর ক্ষতিপূরণ হয়ে যায়। আর হজে মাবরূরের প্রতিদান তো জান্নাত ছাড়া আর কিছুই নয়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৭৭৩; সহিহ মুসলিম: ১৩৪৯; মুসনাদে আহমদ: ৭৩৫৪; সহিহ ইবনে হিববান: ৩৬৯৫)

হজ না আদায়ের শাস্তি ও পরিণাম

রাসূল (সা.) হাদিসে বলেছেন, ‘হজ ফরজ হওয়ার পর তা আদায় না করে মৃত্যুবরণ করা- ইহুদি বা খ্রিস্টান হয়ে মৃত্যুবরণ করার সমতুল্য।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৬৭)

ইসলামে হজের দোয়া ও ফজিলত

সামর্থ থাকার পরও হজ না করার পরিণাম ভয়াবহ। ফরজ হজ ত্যাগ করলে ইহুদি-নাসারার মতো মৃত্যু হবে বলে হাদিসে সতর্ক করা হয়েছে। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি হজ করার সামর্থ্য রাখে, তবুও হজ করে না, সে ইহুদি হয়ে মৃত্যুবরণ করল কি খ্রিস্টান হয়ে, তার কোনো পরোয়া আল্লাহর নেই।’ (ইবনে কাসির : ১/৫৭৮)

আর কেউ যদি হজ অস্বীকার করে বা কোনো ধরনের অবহেলা প্রদর্শন করে তবে সে আল্লাহর জিম্মার বাইরে বলে বিবেচিত হবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘মানুষের মধ্যে যারা সেখানে (বায়তুল্লাহ) পৌঁছার সামর্থ্য রাখে তাদের ওপর আল্লাহর উদ্দেশ্যে এ গৃহের হজ করা ফরজ। আর কেউ যদি অস্বীকার করে, তাহলে জেনে রাখা উচিত যে, আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিজগতের প্রতি মুখাপেক্ষী নন।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ৯৭)

এছাড়াও হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহ তায়ালা হজ না করার পরিণতি সম্পর্কে বলেছেন, ‘যে বান্দাকে আমি দৈহিক সুস্থতা দিয়েছি এবং আর্থিক প্রাচুর্য দান করেছি, অতঃপর (গড়িমসি করে) তার পাঁচ বছর অতিবাহিত হয়ে যায় অথচ আমার দিকে (হজব্রত পালন করতে) আগমন করে না, সে অবশ্যই বঞ্চিত।’ (ইবনে হিব্বান, হাদিস : ৩৭০৩)

হজের সময় ও নির্ধারিত স্থান

হজের নির্দিষ্ট সময়- শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজের প্রথম ১০ দিন। বিশেষত ৮ থেকে ১২ জিলহজ পর্যন্ত পাঁচ দিন। এ পাঁচ দিনই মূলত হজ পালন করা হয়। হজের নির্ধারিত স্থান-কাবা শরিফ, সাফা-মারওয়া, মিনা, আরাফা ও মুজদালিফা। (আসান ফিকাহ, খণ্ড: ০২, পৃষ্ঠা : ২৫১)

হজের তাৎপর্য

ইসলামি ইবাদতসমূহের মধ্যে হজের গুরুত্ব অপরিসীম। এক হাদিস অনুযায়ী হজকে বরং সর্বোত্তম ইবাদত বলা হয়েছে।(১১) তবে হজের এ গুরুত্ব বাহ্যিক আচার- অনুষ্ঠান থেকে বেশি সম্পর্কযুক্ত হজের রুহ বা হাকীকতের সাথে। হজের এ রুহ বা হাকীকত নিম্নে বর্ণিত পয়েন্টসমূহ থেকে অনুধাবন করা সম্ভব।

১) এহরামের কাপড় গায়ে জড়িয়ে আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে হজের সফরে রওয়ানা হওয়া কাফন পরে আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে আখেরাতের পথে রওয়ানা হওয়াকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

২) হজের সফরে পাথেয় সঙ্গে নেয়া আখেরাতের সফরে পাথেয় সঙ্গে নেয়ার প্রয়োজনয়ীতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

৩) এহরাম পরিধান করে পুত-পবিত্র হয়ে আল্লাহর দরবারে হাজিরা দেয়ার জন্য ‘লাব্বাইক’ বলা সমস্ত গুনাহ-পাপ থেকে পবিত্র হয়ে পরকালে আল্লাহর কাছে হাজিরা দেয়ার প্রয়োজনীয়তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। আরো স্মরণ করিয়ে দেয় যে এহরামের কাপড়ের মতো স্বচ্ছ-সাদা হৃদয় নিয়েই আল্লাহর দরবারে যেতে হবে।

৪) ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ বলে বান্দা হজ বিষয়ে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে আল্লাহর যে কোনো ডাকে সাড়া দেয়ার ব্যাপারে সদা প্রস্তুত থাকার কথা ঘোষণা দেয়। এবং বাধাবিঘ্ন বিপদ-আপদ কষ্ট-যাতনা পেরিয়ে যে কোনো গন্তব্যে পৌঁছতে সে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে, এ কথা ব্যক্ত করে।

৫) এহরাম অবস্থায় সকল বিধি-নিষেধ মেনে চলা স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে যে মুমিনের জীবন বল্গাহীন নয়। মুমিনের জীবন আল্লাহর রশিতে বাঁধা। আল্লাহ যেদিকে টান দেন সে সেদিকে যেতে প্রস্তুত। এমনকী যদি তিনি স্বাভাবিক পোশাক- আশাক থেকে বারণ করেন, প্রসাধনী আতর স্নো ব্যবহার, স্বামী-স্ত্রীর সাথে বিনোদন নিষেধ করে দেন, তবে সে তৎক্ষণাৎ বিরত হয়ে যায় এসব থেকে। আল্লাহর ইচ্ছার সামনে বৈধ এমনকী অতি প্রয়োজনীয় জিনিসকেও ছেড়ে দিতে সে ইতস্তত বোধ করে না বিন্দুমাত্র।

৬) এহরাম অবস্থায় ঝগড়া করা নিষেধ। এর অর্থ মুমিন ঝগড়াটে মেজাজের হয় না। মুমিন ক্ষমা ও ধৈর্যের উদাহরণ স্থাপন করে জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে। মুমিন শান্তিপ্রিয়। ঝগড়া-বিবাদের ঊর্ধ্বে উঠে সে পবিত্র ও সহনশীল জীবন যাপনে অভ্যস্ত।

৭) বায়তুল্লাহর সান্নিধ্যে গিয়ে মুমিন নিরাপত্তা অনুভব করে। কেননা বায়তুল্লাহকে নিরাপত্তার নিদর্শন হিসেবে স্থাপন করেছেন আল্লাহ তা’আলা।(১২) সফরের কষ্ট-যাতনা সহ্য করে বায়তুল্লাহর আশ্রয়ে গিয়ে মুমিন অনুভব করে এক অকল্পিত নিরাপত্তা। তদ্রুপভাবে শিরকমুক্ত ঈমানি জীবযাপনের দীর্ঘ চেষ্টা-সাধনার পর মুমিন আল্লাহর কাছে গিয়ে যে নিরাপত্তা পাবে তার প্রাথমিক উদাহরণ এটি। (১৩)

৮) হাজরে আসওয়াদ চুম্বন-স্পর্শ মুমিনের হৃদয়ে সুন্নতের তাজিম-সম্মান বিষয়ে চেতনা সৃষ্টি করে। কেননা নিছক পাথরকে চুম্বন করার মাহাত্ব কী তা আমাদের বুঝের আওতার বাইরে। তবুও আমরা চুম্বন করি, যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেছেন। বুঝে আসুক না আসুক কেবল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনুসরণের জন্যই আমরা চুম্বন করে থাকি হাজরে আসওয়াদ। এ চুম্বন বিনা-শর্তে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আনুগত্যে নিজেকে আরোপিত করার একটি আলামত। ওমর (রাঃ) হাজরে আসওয়াদকে চুম্বন করার পূর্বে বলেছেন, ‘আমি জানি নিশ্চয়ই তুমি একটি পাথর। ক্ষতি-উপকার কোনোটারই তোমার ক্ষমতা নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে চুম্বন করতে না দেখলে আমি তোমাকে চুম্বন করতাম না। (১৪) হাজরে আসওয়াদের চুম্বন, তাই, যুক্তির পেছনে না ঘুরে, আল্লাহ ও রাসূলের নিঃশর্ত আনুগত্যের চেতনা শেখায় যা ধর্মীয় নীতি-আদর্শের আওতায় জীবনযাপনকে করে দেয় সহজ, সাবলীল।

৯) তাওয়াফ আল্লাহ-কেন্দ্রিক জীবনের নিরন্তর সাধনাকে বুঝায়। অর্থাৎ একজন মুমিনের জীবন আল্লাহর আদেশ-নিষেধকে কেন্দ্র করে ঘোরে। এক আল্লাহকে সকল কাজের কেন্দ্র বানিয়ে যাপিত হয় মুমিনের সমগ্র জীবন। বায়তুল্লাহর চার পাশে ঘোরা আল্লাহর মহান নিদর্শনের চার পাশে ঘোরা। তাওহীদের আন্তর্জাতিক কেন্দ্রের চার পাশে ঘোরা। তাওহীদ নির্ভর জীবনযাপনের গভীর অঙ্গীকার ব্যক্ত করা। আর সাত চক্কর চূড়ান্ত পর্যায়কে বুঝায়। অর্থাৎ মুমিন তার জীবনের একাংশ তাওহীদের চার পাশে ঘূর্ণায়মান রাখবে আর বাকি অংশ ঘোরাবে অন্য মেরুকে কেন্দ্র করে, এরূপ নয়। মুমিনের শরীর ও আত্মা, অন্তর-বহির সমগ্রটাই ঘোরে একমাত্র আল্লাহকে কেন্দ্র করে যা পবিত্র কুরআনে ‘পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করো’(১৫) বলে ব্যক্ত করা হয়েছে।

১০) আল্লাহ তা’আলা নারীকে করেছেন সম্মানিতা। সাফা মারওয়ার মাঝে সাত চক্কর, আল্লাহর রহমত-মদদ কামনায় একজন নারীর সীমাহীন মেহনত, দৌড়ঝাঁপকে স্মরণ করিয়ে দেয়। যে শ্রম-মেহনতের পর প্রবাহ পেয়েছিল রহমতের ফোয়ারা ‘যমযম’। সাত চক্করে সম্পূর্ণ করতে হয় সাঈ যা, স্মরণ করিয়ে দেয় যে আল্লাহর রহমত-সাহায্য পেতে হলে সাত চক্কর অর্থাৎ প্রচুর চেষ্টা মেহনতের প্রয়োজন রয়েছে। মা হাজেরার মতো গুটি গুটি পাথর বিছানো পথে সাফা থেকে মারওয়া, মারওয়া থেকে সাফায় দৌড় ঝাঁপের প্রয়োজন আছে। পাথুরে পথে সাত চক্কর, তথা প্রচুর মেহনত ব্যতীত দুনিয়া- আখেরাতের কোনো কিছুই লাভ হবার মতো নয় এ বিধানটি আমাদেরকে বুঝিয়ে দেয় পরিষ্কারভাবে।

১১) উকুফে আরাফা কিয়ামতের ময়দানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যেখানে সমগ্র মানবজাতি একত্রিত হবে সুবিস্তৃত এক ময়দানে। যেখানে বস্ত্রহীন অবস্থায় দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে গুণতে হবে অপেক্ষার প্রহর। সঠিক ঈমান ও আমলের অধিকারী ব্যক্তিরা পার পেয়ে যাবে আল্লাহর করুণায়। আর ইমানহীন-ত্রুটিপূর্ণ ঈমান ও আমলওয়ালা ব্যক্তিদেরকে অনন্ত আযাব ভোগ করাতে শেকল পরিয়ে ধেয়ে নেয়া হবে জাহান্নামের পথে।

হজের আরও ফজিলত : হজের ফজিলতের ব্যাপারে বিভিন্ন হাদিস বর্ণিত হয়েছে। নিচে তা উল্লেখ করা হলো:

(১) আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘এক ওমরা পরবর্তী ওমরা পর্যন্ত গোনাহের (ছগীরাহ) কাফফারাহ এবং কবুল হজের প্রতিদান জান্নাত ব্যতীত কিছইু নয়’ (বুখারী হা/১৬৫০; মুসলিম হা/১৩৪৯; মিশকাত হা/২৫০৮)। অর্থাৎ হজের বিনিময় হচ্ছে জান্নাত। কবুল হজ দ্বারা উদ্দেশ্য এমন হজ, যা সুন্নাত মুতাবেক সম্পন্ন হয়, যাতে পাপাচার ও গোনাহ থেকে মুক্ত থাকা হয় (রিয়াযুছ ছালেহীন হা/১২৮১-এর ব্যাখ্যা)। কবুল হজের আলামত সম্পর্কে বিদ্বানগণ বলেছেন যে, হজের পর লোকটি উত্তম আচার-ব্যবহারের দিকে ধাবিত হয়ে যায়। সে যদি খারাপ থাকে তাহলে সৎ কর্মশীল হয়ে যায়, সৎ কর্মশীল থাকলে আরো অধিকতর সৎকর্মশীল হয়ে যায় (ফাতহুল বারী ৩/৪৪৬, হা/১৫১৯-এর ব্যাখ্যা)। আর হজকারী যদি নিজের পূর্বের কাজের উপর বিদ্যমান থাকে তাহলে তা হজ কবুল না হওয়ার ইঙ্গিত বহন করে।

ইসলামে হজের দোয়া ও ফজিলত

(২) আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছেন, ‘যে ব্যক্তি হজ করল এবং হজের সময় অনর্থক কথা ও পাপ কাজ করল না সে হজ থেকে প্রত্যাবর্তন করে সেদিনের ন্যায় (নিষ্পাপ অবস্থায়), যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিল’ (বুখারী হা/১৫২১; মুসলিম হা/৩২৯১)।

(৩) আমর ইবনুল আছ (রা.) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে সম্বোধন করে বললেন, ‘হে আমর! তুমি কি জান যে, ইসলাম গ্রহণের দিন (পূর্বের) গোনাহসমূহ মিটিয়ে দেয়? আর হিজরত পূর্বের পাপ মোচন করে দেয়, হজ পূর্বের গোনাহ ধ্বসিয়ে করে দেয়’ (মুসলিম হা/৩২১)।

ইসলামে হজের দোয়া ও ফজিলত

(৪) উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, হে আল্লাহ্র রাসূল (সা.)! আমরা জিহাদকে সর্বোত্তম আমল মনে করি। তাহলে আমরা (মহিলারা) কি জিহাদ করব না? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, না, তোমাদের জন্য উত্তম জিহাদ হচ্ছে, মাবরূর (কবুল) হজ’ (বুখারী হা/১৫২০)। অপর একটি বর্ণনায় এসেছে,

(৫) আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহ্র রাসূল (সা.)! মহিলাদের উপর কি জিহাদ আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তাদের উপর জিহাদ আছে। তবে তাতে যুদ্ধ নেই। সেটা হল হজ ও ওমরা’ (ইবনু মাজাহ হা/২৯০১; মিশকাত হা/২৫৩৪)।
(৬) আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হল কোন আমল সর্বোত্তম? রাসূল (সা.) বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর ঈমান আনা। বলা হল, এরপর কি? তিনি বললেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। জিজ্ঞেস করা হল, তারপর কি? তিনি বললেন, মাবরূর হজ (কবুল হজ) (বুখারী হা/২২; মুসলিম হা/২৪৮; মিশকাত হা/২৫০৬)।

হজের উপকারিতা

হজ ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের মধ্যে অন্যতম। এটা ইসলামের বড় ইবাদত হওয়া ছাড়াও এর বিভিন্ন উপকারিতা রয়েছে। কুরআনুল কারীমে এ ব্যাপারে ইঙ্গিত করা হয়েছে। আল্লাহ্র বাণী, ‘যাতে তারা তাদের কল্যাণময় স্থানগুলোতে উপস্থিত হতে পারে’ (হজ ২২/২৮)।

এ আয়াতে বহুবচনের শব্দ ব্যবহার করে ধর্মীয়, দৈহিক, আর্থিক, সাংস্কৃতিক, দাওয়াতী, ইলমী (জ্ঞানগত) ও একতা-সংহতির উপকারিতাকে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।

ইসলামে হজের দোয়া ও ফজিলত

১. দ্বীনি (ধর্মীয়) উপকারিতা

ক. মুখলিছ (একনিষ্ঠ) হাজি গোনাহ থেকে পাক-সাফ বা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে যায়, যা পূর্বোক্ত হাদিসে উল্লিখিত হয়েছে।
খ. মক্কায় অবস্থানের সময় মসজিদে হারামে সালাত আদায় করার সৌভাগ্য হয়। যেখানে সালাত আদায়ে অন্যান্য মসজিদের চেয়ে ১ লক্ষ গুণ ছওয়াব বেশি হয়।
গ. মক্কায় অবস্থানকালে কাবার তওয়াফ করতে থাকার সৌভাগ্য হয়। তওয়াফ এমন ইবাদত, যা ঐ জায়গা ব্যতীত অন্যত্র আদায় করা সম্ভব হয় না।
ঘ. অন্তরে গোনাহের যে মরিচা পড়ে, তা আল্লাহ্র ঘর দর্শন ও তার পার্শ্বে কিছু দিন অতিবাহিত করার মাধ্যমে পরিষ্কার হয়ে যায় এবং মানুষের মাঝে উত্তম কাজের আগ্রহ অত্যধিক বৃদ্ধি পায়।
ঙ. হজের সময় প্রতি পদক্ষেপে পৃথিবীর সমগ্র মানবতার মহান তাওহীদবাদী ও কা‘বার পুনঃনির্মাণকারী ইবরাহীম (আ.), তাঁর পরিজন হাজেরা ও পুত্র ইসমাঈল (আ.)-এর পবিত্র জীবনের চিত্র অন্তরে চিত্রিত হয়। যা দ্বীনের উপর অটল থাকতে সহায়ক হয় এবং মানুষের মাঝে দীপ্তিমান জীবনের মশালবাহী বা দিকনির্দেশক হওয়ার জাযবাহ তৈরি করে।
চ. হজের সময় মক্কা মুকাররমা ও মদীনা মুনাওয়ারার কিছু ঐতিহাসিক স্থান দর্শনের সুযোগ হয়, যাতে ইসলামের সূচনা লগ্নের ইতিহাস স্মৃতির ফলকে বদ্ধমূল হয়ে যায়। এর ফলে ঈমানে সজিবতা, আস্থা এবং নিশ্চিত বিশ্বাসে দৃঢ়তা পয়দা হয়।
ছ. কাবা ঘর ও অন্যান্য পবিত্র নিদর্শন এবং হজের বিশাল জমায়েত-সমাবেশ দেখে ইসলামের সত্যতা অন্তরে বদ্ধমূল হয়ে যায়। হজের এই ধর্মীয় উপকারিতা ছাড়াও অন্যান্য বহু উপকারিতা রয়েছে।

২. দৈহিক উপকারিতা

হজের সফরে এবং হজ চলাকালীন সময়ে হাজিদেরকে শারীরিক পরিশ্রমও করতে হয়। অনেক আরাম প্রিয় ও সওয়ারীতে অভ্যস্ত লোকদেরকেও অধিকাংশ সময় পদব্রজে চলতে হয়। যা তার দৈহিক সুস্থতার উপরে সুপ্রভাব ফেলে। তদ্রƒপ মক্কায় অবস্থানকালে জমজমের পানি পান করাতেও স্বাস্থ্য ভালো হয়ে যায়। আল্লাহর রহমতে বহু দুরারোগ্য ব্যাধি উপশম হয়ে যায়। যেরূপ বিভিন্ন ঘটনা থেকে জানা যায়।

৩. আর্থিক উপকারিতা

হজের দৃঢ় নিয়তকারী কোন ব্যক্তি যদি হজ চলাকালীন সময়ে অবসরে কোন ব্যবসা করতে চায় এবং ইসলামী নিয়ম-কানুন মোতাবেক ব্যবসা করে, তাহলে ইসলাম সেক্ষেত্রে অনুমতি দিয়েছে। যেমন পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের প্রতিপালকের অনুগ্রহ সন্ধান করাতে তোমাদের কোন পাপ নেই’ (বাক্বারাহ ২/১৯৮)। এখানে ‘অনুগ্রহ’ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্থনৈতিক উপকারিতা। সূরা হজের ২৭ ও ২৮নং আয়াতে হজ সম্পর্কিত বিধান ঘোষণার সাথে ইবরাহীম (আ.)-এর নিকট তার উপকারিতা ও লাভজনক দিকও উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন এরশাদ হয়েছে, ‘আর মানুষের নিকট হজের ঘোষণা কর, তারা তোমার নিকট আসবে পদব্রজে ও সর্বপ্রকার ক্ষীণকায় উষ্ট্রের পিঠে, তারা আসবে দূর-দূরান্তের পথ অতিক্রম করে। যাতে তারা তাদের কল্যাণময় স্থানগুলোতে উপস্থিত হতে পারে এবং তিনি তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তু হতে যা রিজিক দান করেছেন তার উপর নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে পারে’ (হজ ২২/২৭-২৮)।

উপকারের তালিকায় মুফাসসিরগণ দ্বীনি ও আর্থিক উপকারিতা উভয়ই উল্লেখ করেছেন যে, ব্যবসা-বাণিজ্য ও কারবার দ্বারা দুনিয়াবী সচ্ছলতা অর্জিত হতে পারে।

ইসলামে হজের দোয়া ও ফজিলত

৪. সাংস্কৃতিক উপকারিতা

হজ যেহেতু বিশ্বের অদ্বিতীয়, অনন্য ও বিশাল জনসমাবেশ, যাতে দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোক এসে মক্কায় সমবেত হয়। কেউ আরব, কেউ অনারব, কেউ প্রাচ্য, কেউ পাশ্চাত্য থেকে আগমন করে। কেউ কালো, কেউ সাদা, কোন দেশের অধিবাসী দীর্ঘকায় শক্তিশালী, কোন দেশের নাগরিক খর্বকায় ও দুর্বল। এ সমস্ত লোকের বর্ণ-গোত্র, ভাষা ও সাংস্কৃতি ভিন্নতর হওয়া সত্ত্বেও একই কেন্দ্রে সমবেত হয়। এ অবস্থায় লোকেরা একে অপরের তাহযীব-তামাদ্দুন, সভ্যতা-সংস্কৃতি, তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ, রীতি-নীতি, আকার-আকৃতি, অভ্যাস-প্রকৃতি, খাদ্য-পানীয় প্রভৃতি সম্পর্কে জানার সুযোগ পায়। এ সময় সুচতুর হজকারী ইচ্ছা করলে অন্যদের স্বভাব-প্রকৃতি, রীতি-পদ্ধতি, সভ্যতা-সংস্কৃতিতে নিজেকে ভূষিত করতে পারে। আর অন্যের উত্তম গুণাবলী গ্রহণ করে নিজেকে আরো সুন্দর ও পরোপকারী মানুষে পরিণত করতে পারে।

হজের গুরুত্ব ও ফজিলত

৫. ঐক্য-সংহতির উপকারিতা

হজের বিশাল সমাবেশে ভিন্ন বর্ণ-গোত্র, স্বতন্ত্র ভাষা, পৃথক সভ্যতা-সংস্কৃতির মানুষ একত্রিত হয়। যা মূলত ইসলামী ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের সুস্পষ্ট ও শক্তিশালী প্রকাশ। একজন হাজি ইউরোপের কোন উন্নত দেশের, কেউ আফ্রিকার পশ্চাৎপদ দেশের, কেউবা এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশের নাগরিক। সবাই এক সাথে কাবা ঘরের তাওয়াফ করে, ছাফা-মারওয়ার মাঝে সাঈ করে, আরাফায় একত্রে অবস্থান, মুযদালিফার উদ্দেশ্যে এক সাথে যাত্রা, এক সাথে মিনায় অবস্থান ও কংকর নিক্ষেপ এবং হজের সকল রুকন মিলে মিশে পালন করে। মসজিদে হারামে একে অপরের সাথে মিলে সালাত আদায় করে। হজের সমস্ত কর্মকা- ও ইবাদত আদায়ের ক্ষেত্রে কারো উপরে কারো মর্যাদা ও প্রাধান্য নেই। সবাই পরস্পরের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখে এবং একে অপরকে সম্মান ও সেবা করার প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি হয়। এটা এমনই একতা বা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ফায়েদা যা কেবল হজের সমাবেশকালে অর্জিত হয়।

৬. ইসলামী (জ্ঞানগত) ও দাওয়াতী উপকারিতা

হজের ইলমী ও দাওয়াতী বহু উপকারিতা সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত। বিশেষত বিদ্বানগণের জন্য হজের এ বিশাল সমাবেশ কোন শিক্ষা সম্মেলন ও সেমিনার অপেক্ষা কোন অংশে কম নয়। এখানে সারা পৃথিবীর বিদ্বানগণ একত্রিত হন। একে অপরের সাথে সাক্ষাৎ করে ধর্মীয় বিষয় ও ফিক্বহী মাসআলা সম্পর্কে পারস্পরিক চিন্তাধারা আদান-প্রদান করতে পারেন এবং একে অপরের নিকট থেকে ইলমী উপকার লাভ করতে পারেন। যে যুগে বর্তমান সময়ের মত গ্রন্থ মুদ্রণ ও প্রকাশের ব্যাপকতা ছিল না এবং শিক্ষা-দীক্ষারও আরামদায়ক মাধ্যম বিদ্যমান ছিল না, তখন দুনিয়ার বিদ্বানগণের জন্য হজের মৌসুমই সমবেত হওয়ার ও সাক্ষাতের মাধ্যম ছিল। ইতিহাসের পাতায় ১০টি এমন ঘটনা পাওয়া যায়, যাতে ঐ ধরনের শিক্ষা সমাবেশের বর্ণনা রয়েছে।

ইসলামে পবিত্র হজের গুরুত্ব ও ফজিলত

ইলমী উপকারিতার সাথে সাথে হজের দাওয়াতী ফায়েদাও সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত। হজের সময় হাজিগণের ধর্মীয় বিষয় এমন অনেক বিষয়ের জ্ঞান লাভ হয়, যে বিষয়ে তাদের জ্ঞান ছিল না। এ সময়ে সউদি সরকার হাজিদের মাঝে দাওয়াত-তাবলীগ এবং তাদেরকে ধর্মীয় বিষয়ে দিক নির্দেশনা দান করার জন্য তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে। সকল দেশ ও এলাকার বিভিন্ন ভাষার বিদ্বান ও মুবাল্লিগগণের দল জায়গায় জায়গায় দিক নির্দেশনার জন্য প্রস্তুত থাকেন। বিশেষ করে মুসলমানদের আক্বীদা ও আমল সংশোধনের ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়। যদি কোন হাজি একনিষ্ঠতার সাথে ঐসব প্রোগ্রাম থেকে উপকার লাভের ইচ্ছা করে এবং হজের সফরকে পিকনিক এবং পর্যটন ও প্রমোদ বিহারের প্রোগ্রাম হিসাবে গ্রহণ না করে নিজেকে সংশোধনের চেষ্টা করে তাহলে নিঃসন্দেহে সে অতি বড় উপকার লাভ করতে পারবে। এছাড়াও (উপরে বর্ণিত উপকারিতা ছাড়াও) হজের আরো নানা ধরনের উপকারিতা-ফায়েদা ও লাভ রয়েছে, যা দূরদর্শীদের দৃষ্টির অন্তরালে নয়।

প্রিয় পাঠক, শিক্ষা ও ক্যারিয়ার বিষয়ক সর্বশেষ আপডেট পেতে মুক্ত ক্যাম্পাসের ফেসবুক পেজে লাইক দিন। লিঙ্ক : https://www.facebook.com/Muktocampus

পূর্ববর্তী নিবন্ধগুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার প্রবেশপত্র ডাউনলোড ২০২২ শুরু
পরবর্তী নিবন্ধপ্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ২০২২ : পদ ১৫৩টি