জাপানের সেরা তরুণ বিজ্ঞানী বাংলাদেশের ডা. আরিফ

নিজস্ব প্রতিবেদক
বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর ২০১৯ | ৫:০৬ অপরাহ্ণ | 164 বার পঠিত

এ বছরের জাপানের সেরা তরুণ বিজ্ঞানী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশের ডা. আরিফ হোসেন। জাপান মেডিকেল সায়েন্সের ইতিহাসে এটি একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। ৬১ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো বিদেশিকে এ গৌরবময় পুরস্কারের জন্য নির্বাচন করা হলো।

গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে জন্মগ্রহণ করা এ তরুণ বর্তমানে জাপানের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র রিসার্চার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।

প্রতিবছর জাপানিজ সোসাইটি অব ইনহেরিটেড ম্যাটাবলিক ডিজঅর্ডার’স (জেএসআইএমডি) সেরা জাপানিজ তরুণ বিজ্ঞানী নির্বাচন করে থাকে। লাইসোসোমাল (Lysosomal diseases Gi mechanisms) রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থা উদ্ভাবনের জন্য এ বছর জাপানের সেরা তরুণ বিজ্ঞানী হিসেবে নির্বাচিত হন বাংলাদেশের ডা. আরিফ হোসেন। স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) জাপানিজ সোসাইটি ফর ইনহ্যারিটেড ম্যাটাবলিক ডিজিজের ৬১তম বার্ষিক সম্মেলনে এ সম্মাননা তুলে দেয়া হয় ডা. আরিফ হোসেন এর হাতে।

সুথুমু টাকাহাশীর সভাপতিত্বে তিনদিনব্যাপী এ সম্মেলনটি দেশটির আকিটা ক্যাসটল হোটেলে আয়োজন করা হয়। সম্মেলনটির শেষ হয় ২৬ অক্টোবর।

জানা যায়, ডা. আরিফ হোসেন গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীর ভাটিয়াপাড়ার খুব সাধারণ পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। ১১ ভাইবোনের মধ্যে ডা. আরিফ হোসেন সবার ছোট। তিনি এসএসসি পর্যন্ত গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা করেন। তারপর ঢাকার মিরপুর বাঙলা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে প্রথমে এমবিবিএস পাস করে একই প্রতিষ্ঠান থেকে শিশু বিভাগে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করেছেন।

পুরস্কার পাওয়ার পর গণমাধ্যমকে ডা. আরিফ হোসেন বলেন, আমি অনেক আনন্দিত। এটা আমার জন্য ও বাংলাদেশের জন্য একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা।

ডা. আরিফ হোসেন জাপানের ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে তিনি শিশু নিউরো- মেটাবলিক রোগে ক্লিনিক্যাল ফেলোশিপও করেন। নিউরো-মেটাবলিক রোগের ওপর উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে ওই রোগের বিশেষজ্ঞ হিসেবে জাপানে সিনিয়র গবেষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।

নিউরো-মেটাবলিক রোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, নিউরো-মেটাবলিক রোগ সাধারণত জেনেটিক কারণে হয়। অর্থাৎ, মায়ের পেট থেকে বাচ্চা জিন Defect নিয়ে বের হয়, পরবর্তীতে ব্রেন, লিভার, কিডনি, হার্ট সহ নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে বিভিন্ন ধরণের সমস্যা দেখা দেয়। এই রোগীদের সংখ্যা নেহাত কম নয়, কিন্তু এদের চিকিৎসা এবং গবেষণা খুব কম হয়েছে। তাই আমি সেটা নিয়ে কাজ করে আনন্দবোধ করি।

ডা. আরিফ হোসেন এছাড়াও ন্যাচার গ্রুপের জার্নাল ‘জার্নাল অব হিউম্যান জেনেটিক্স’ এ পৃথিবীর সেরা তিন তরুণ বিজ্ঞানীর একজন নির্বাচিত হয়েছেন। এছাড়া ২০১৭ সালে তিনি আন্তর্জাতিক আরো দুটি সম্মাননা পেয়েছেন।

জার্নাল অব হিউম্যান জেনিটিক্সের সম্পর্কে আরিফ হোসেন বলেন, পৃথিবীতে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কিছু জার্নাল আছে এর মধ্যে একটা হচ্ছে Journal of Human Genetics. সেখানে হিউম্যান জেনেটিক্সের ওপর নতুন রিসার্চগুলো যাচাই বাছাইয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়।

চিকিৎসা পেশায় না গিয়ে গবেষণায় যুক্ত হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, উন্নত বিশ্বে প্রায় প্রত্যেক চিকিৎসকেরই নিজস্ব গবেষণা থাকে, অর্থাৎ ফিজিশিয়ান কাম রিসার্চার। আমি আসলে একজন শিশু নিউরো-মেটাবলিক রোগ বিশেষজ্ঞ।

গবেষণায় অ্যাওয়ার্ড পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি যে নিউরো-মেটাবলিক রোগ নিয়ে কাজ করি এই অ্যাওয়ার্ডটা পেয়েছি তার নাম হল Krabbe disease এই রোগে শিশু সাধারণত মায়ের পেট থেকে জিন Defect নিয়ে বের হয়, পরবর্তীতে ব্রেইন মারাত্মকভাবে Affected হয়। যেমন বাচ্চা প্রচণ্ড কান্নাকাটি করে, খিচুনি হয়, হাত-পা প্যারালাইজড হয় ইত্যাদি। এই রোগের ডায়াগনোসিস খুবই কঠিন।

আমার গবেষণার বিষয় ছিল, সহজেই কীভাবে রোগটা ডায়াগনোসিস করা যায়। এটা ছিল আমার প্রথম প্রজেক্ট। ওই প্রজেক্টে আমি সফল হয়েছি। সফল হওয়ার পরে এটা আমি Gene জার্নালে পাবলিশ করেছি ২০১৪ সালে। সেটা ছিল আমার পিএইচডির থিসিস। পরবর্তীতে এই রোগের চিকিৎসার সহজলভ্য উপায় খুঁজছিলাম, কেননা এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে Krabbe disease চিকিৎসার একটাই উপায় আছে, আর তা হল Stem cell transplantation. এটা খুবই ব্যয় সাপেক্ষ এবং ঝুঁকিপূর্ণ চিকিৎসা। আমাদের দেশে বোনম্যারু ট্রান্সপ্লান্টেশনের মতো।

আমি যেটা করেছি, কিছু ড্রাগ আছে যেগুলোকে বলে  Chemical chaperone (ছোট সাইজের প্রোটিন), এই Chemical chaperone এর নাম হচ্ছে NOEV. আমি এই NOEV দিয়ে Krabbe disease এর চিকিৎসা Laboratory তে করে আলহামদুলিল্লাহ্ সফল হয়েছি। যেটা Journal of Human Genetics-এ পাবলিশ হয়েছিল ২০১৫ সালে।

আমিই হলাম পৃথিবীতে প্রথম ব্যক্তি যে এই সফলতা অর্জন করেছে। পরবর্তীতে আমার গবেষণা বিজ্ঞানীদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভে করে। যার ফলশ্রুতিতে Journal of Human Genetics এর বিশেষজ্ঞ প্যানেল আমাকে ২০১৭ সালের সেরা বিজ্ঞানী নির্বাচিত করেছে।’

সফলতার পেছনে মা সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা বলে জানান তিনি। তারপর তার তৃতীয় ভাই মকবুল হোসেন, যিনি সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছেন তার সফলতার পেছনে। এছাড়া অন্যান্য ভাইবোন ও স্ত্রীর অবদানও অনস্বীকার্য বলে জানান তিনি।

মা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘নিজের সবটুকু শক্তি দিয়ে তাঁর সন্তানদের মানুষ করার চেষ্টা করেছেন। আমি হলাম সবার ছোট। স্বাভাবিকভাবেই মায়ের সাথে আমার যোগাযোগটা সবার থেকে একটু আলাদা। মা চাইতেন আমি যেন বিশ্ববিখ্যাত ডাক্তার হতে পারি।’ চিকিৎসা পেশায় গবেষণার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন তরুণ এ বিজ্ঞানী।

মুক্ত ক্যাম্পাস/জেডআর

পূর্ববর্তী নিবন্ধনোবিপ্রবিতে ভর্তিচ্ছুদের থাকা-খাওয়ার বিশাল আয়োজন
পরবর্তী নিবন্ধপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিএসটিআইয়ের জরিমানা ও মামলা