গ্রাম আলোকিত করার নায়ক শাহরিয়ার

নিজস্ব প্রতিবেদক
শুক্রবার, ২৪ জানুয়ারি ২০২০ | ৯:০০ পূর্বাহ্ণ | 166 বার পঠিত
গ্রাম আলোকিত করার নায়ক শাহরিয়ার

প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনতে কাজ করছে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির জ্বালানি গবেষণা কেন্দ্র। যেখানে গবেষণাগারটির পরিচালক শাহরিয়ার আহমেদের পরিচালনায় কাজ করছেন আরো ছয়জন গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশকিছু শিক্ষার্থী। পুরো একটা গবেষণাগার চলছে সৌরবিদ্যুতে। রাজধানী ঢাকার প্রাণকেন্দ্র ধানমন্ডিতেই সে গবেষণাগারের অবস্থান। অবাক হলেও সত্যি, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির জ্বালানি গবেষণা কেন্দ্রের কার্যক্রম চলে সূর্যের আলো সংগ্রহ করে। সেন্টার ফর এনার্জি রিসার্চ নামে চমৎকার সে গবেষণাগার তৈরির পেছনে কাজ করেছেন শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী। গ্রাম আলোকিত করার নায়ক তিনি।

যেকোনো দেশের উন্নয়নের পূর্বশর্ত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ শক্তি। নবায়নযোগ্য ও টেকসই জ্বালানি গবেষণার জন্য ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সেন্টার ফর এনার্জি রিসাচ। এর উদ্দেশ্য জ্বালানি ব্যবস্থাপনা, নীতিমালা গঠন এবং এর যথাযোগ্য ব্যবহারের উপায় নিয়ে গবেষণা করা। এজন্য বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় একটি ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও জলবায়ু মোকাবেলায় ৫০টি প্রকল্প পরিচালনা করা হয়েছে গবেষণা কেন্দ্রের মাধ্যমে। এছাড়া দেড় হাজার প্রকৌশলীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে সোলার প্রযুক্তির ওপর।

জ্বালানি খাত নিয়ে বিভিন্ন দেশের ইনস্টিটিউট ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কাজ করেছে জ্বালানি গবেষণা কেন্দ্র। পেয়েছে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পুরস্কার। বিশ্বব্যাংক, জিআইজেড ও সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিসহ দেশী-বিদেশী অনুদানে বেশ কয়েকটি গবেষণা প্রকল্প চলছে এ কেন্দ্রে। ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরীর হাত ধরেই এর যাত্রা। বর্তমানে তিনি এর পরিচালক। শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী বলেন, এ ধরনের গবেষণাগার বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রথম। এ পর্যন্ত প্রায় ৩০০ সোলার হোম সিস্টেমের বাতি, চার্জার, এসি-ডিসি কনভার্টার ও ব্যাটারি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় এ ল্যাবে।

১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস কৌশলে স্নাতক করেন শাহরিয়ার। যোগ দেন বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সরকারি চাকরিতে। তারপর জার্মান সরকারের বৃত্তি নিয়ে পড়তে যান সে দেশের ওল্ডেনবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে তিনি এমন এক সৌরবিদ্যুৎ কোষ (সোলার সেল) আবিষ্কার করেন, যা সূর্যের আলো থেকে প্রচলিত সোলার প্যানেলের চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে।

২০০৭ সালে ফিরে আসেন দেশে। পিডিবির চাকরি ছেড়ে যোগ দেন ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে (ইউআইইউ)। বিশ্ববিদ্যালয়টির স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য নবায়নযোগ্য শক্তির ওপর ভিত্তি করে একটি কোর্সের সিলেবাস তৈরি করেন শাহরিয়ার, বাংলাদেশে যা ছিল প্রথম। ২০১০ সালে এখানে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে চালু হয় সেন্টার ফর এনার্জি রিসার্চ। বর্তমানে সরকারের নবায়নযোগ্য শক্তি নীতিমালা প্রণয়নেও যুক্ত হয়েছেন শাহরিয়ার। দেশে ও বিদেশে এ পর্যন্ত শাহরিয়ারের অধীনে ১৫০টির মতো প্রকল্প সফল হয়েছে।

দেশে অনেক বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রের নকশা করেছেন শাহরিয়ার আহমেদ। ২০১৭ সালে তার হাত ধরেই সূর্যের আলো থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ যুক্ত হলো বিদ্যুতের জাতীয় গ্রিডে। জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে পিডিবি প্রাঙ্গণে আট একর জায়গার ওপর বিশাল এক সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র গড়ে ওঠে। সূর্যের আলো যখন থাকবে, তখন এখানে উৎপাদিত হয় ৩ দশমিক ২৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। সরাসরি যোগ হয় জাতীয় গ্রিডে। এনগ্রিন পাওয়ার প্লান্টের পরামর্শক হিসেবে এ বিশাল সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ডিজাইন করেছেন শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী।

শাহরিয়ার রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চর আষাঢ়ীদহে এনজিওর উদ্যোগে তৈরি মিনি গ্রিড সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র ও সরবরাহ ব্যবস্থারও নকশা করেন। এছাড়া কাপ্তাইয়ে নির্মীয়মাণ সোলার প্যানেলের নকশাসহ বাংলাদেশের প্রায় বেশির ভাগ সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের নকশা করেছেন তিনি। দেশের বাইরে নাইজেরিয়া, কেনিয়াতে সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের নকশা করেন শাহরিয়ার। তিনি বলেন, দেশের মোট ১৭টি চরাঞ্চলে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ করছি আমরা। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহের কারণে কিন্তু তাদের জীবনধারারই পরিবর্তন হয়েছে।

২০১৬ সালে তার ‘পিয়ার-টু-পিয়ার স্মার্ট ভিলেজ গ্রিড’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রকল্প মরক্কোতে জাতিসংঘের ২২তম জলবায়ু সম্মেলনে ‘ইউএন মোমেন্টাম ফর চেঞ্জ’ অ্যাওয়ার্ড এবং জার্মানির মিউনিখে ‘ইন্টারসোলার অ্যাওয়ার্ড ২০১৬’ জিতেছে। ‘স্মার্ট সোলার ইরিগেশন সিস্টেম’ শীর্ষক তার আরো একটি গবেষণা প্রকল্প বাংলাদেশ সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় আয়োজিত ‘অদম্য বাংলাদেশ- ২০১৬’ পুরস্কার লাভ করে।

প্রত্যন্ত অঞ্চলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পে বেশ সাফল্য দেখিয়েছে ইউআইইউর জ্বালানি গবেষণা কেন্দ্র। ২০১৭ সালে জাতীয় বিদ্যুৎ সপ্তাহে ইন্টার ইউনিভার্সিটি ইনোভেশন কম্পিটিশনে রানার আপ অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন জ্বালানি গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী। ২০১৮ সালে জাতীয় বিদ্যুৎ সপ্তাহ উপলক্ষে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ইনোভেশন প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান লাভ করে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ‘ডিমান্ড রেসপন্স অ্যানাবলড স্মার্ট গ্রিড’ প্রকল্প। এ উদ্ভাবনী প্রকল্প স্বয়ংক্রিয়ভাবে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুতের লোড ব্যবস্থাপনা এবং বিদ্যুৎ চুরির বার্তা সেবাদাতার কাছে পাঠাতে পারবে। এছাড়া মোবাইলের মাধ্যমে গ্রাহকের বৈদ্যুতিক সেবার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা যাবে। গত ৯ অক্টোবর এ প্রকল্প গবেষণার জন্য প্রথমবারের মতো প্রায় ৪ কোটি টাকার গবেষণা অনুদান দিয়েছে বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কেন্দ্র।

যত পুরস্কার শাহরিয়ারের:

অদম্য বাংলাদেশ ও অনির্বাণ আগামী পুরস্কার। জাতীয় বিদ্যুৎ সপ্তাহ। ২০১৬ ও ২০১৮।
জাতিসংঘের মোমেন্টাম ফর চেঞ্জ পুরস্কার। জাতিসংঘের জলাবায়ু সম্মেলন (কোপ ২২), মারাকেশ, মরোক্কো। ২০১৬।
ইন্টারসোলার (ইউরোপ) অ্যাওয়ার্ড, মিউনিখ, জার্মানি। ২০১৬।
এডুকেশন লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড ২০১৮। সপ্তম ওয়ার্ল্ড এডুকেশন কংগ্রেস, মুম্বাই, ভারত।
এশিয়ান ফটোভল্টেয়িক ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন (এপিভিআইএ) অ্যাওয়ার্ড, সাংহাই, চীন। ২০১৯।

মুক্ত ক্যাম্পাসের সঙ্গে যুক্ত থাকতে এখানে ক্লিক করুন

মুক্ত ক্যাম্পাস/কেএসআর

পূর্ববর্তী নিবন্ধভারতীয় যুদ্ধ বিমানের প্রথম নারী পাইলট অবনী
পরবর্তী নিবন্ধমিরপুরের চলন্তিকা বস্তিতে অগ্নিকাণ্ড