কাশ্মীরের পরতে পরতে সৌন্দর্যের হাতছানি…

শনিবার, ১৫ জুন ২০১৯ | ১১:০৮ অপরাহ্ণ | 897 বার পঠিত

পৃথিবীর ভূস্বর্গ খ্যাত কাশ্মীরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর স্বাস্থ্যকর আবহাওয়ার কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। যেকোনো ভ্রমণপিপাসু ব্যক্তির কাছে এটি পছন্দের তালিকায় শীর্ষে থাকবে। কারণ কাশ্মীরের পরতে পরতে সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে। কাশ্মীর যাবেন কিভাবে, খরচ কেমন হবে, সেখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেমন এসব প্রশ্ন অনেকের মনেই এসে থাকে। আজকের আয়োজনে মুক্ত ক্যাম্পাসের সুহৃদ হেদায়েতুল ইসলাম জুয়েলের কাশ্মীর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা পাঠকের সামনে হুবহু তুলে ধরা হলো :

আতিথেয়তা:

জম্মু এবং কাশ্মীর ব্যাংক (J&K Bank) এ চাকরি করা এক ভদ্র মহিলা ট্রান্সফার হয়ে উনার স্বামীসহ বাচ্চাদের নিয়ে শ্রীনগর আসছিলেন। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তায় মা-ছেলের বমি হলে ব্যাগ থেকে উনাদেরকে এ্যামোডিস ট্যাবলেট দেই। বমিটমি করে একটু স্থির হওয়ার পরে উনার কৃতজ্ঞতা দেখে আমি অস্বস্থিতে পড়ে যাই। ব্যাগ থেকে খাবার বের করে দিচ্ছিলেন। না খেলে উনি আরও বেশি ইন্সিস্ট করছিলেন। বাচ্চাদের দিয়েও অনুরোধ করিয়েছেন । বাড়ি যাওয়ার জন্য অনেক জোরাজুরিও করেন। আমাদের ফিক্সট প্লান থাকায় যাইনি।

শ্রীনগরে মুষলধারে বৃষ্টির কারণে টানা একদিন হোটেল থেকে বের হতে পারিনি। রাতে একটু হাঁটতে বের হয়ে কখন যে বারোটা বেজে গেছে সেদিকে খেয়াল ছিলো না। পথে মোকতার নামে এক কাশ্মীরি ছেলের সাথে পরিচয় হয়। বাংলাদেশ থেকে কাপড় নিয়ে এসে এখানে ব্যবসা করেন। উনার সাথে অনেক কথা হয়। ভদ্রলোক কাস্টমারদের কাছ থেকে নাকি ১৫ পার্সেন্টের চেয়ে বেশি নেন না। এর চেয়ে বেশি লাভ করাটা নাকি উনার কাছে ইনজাস্টিস। বিদায় নেওয়ার সময় বাড়ি যাওয়ার জন্য বললেন। কিন্তু আমরা যাচ্ছি না দেখে দেরী হয়ে যাওয়ায় উনি নিজেই ড্রাইভ করে আমাদেরকে হোটেলে পৌঁছিয়ে দেন।

Kashmirপেহেলগাম যাওয়ার পথে রাস্তা চিনতে পারছিলাম না। নতুন বিবাহিত ২৭/২৮ বছর বয়সী এক লোক কিছু না চেনা উনার লাদাখী স্ত্রী’কে রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেন। প্রায় ২০/২৫ মিনিট ধরে খোঁজাখুজি করে আমাদেরকে গাড়ি ম্যানেজ করে দেন।

পেহেলগাম পৌঁছে ক্যামেরার চার্জ শেষ হয়ে যাওয়ায় “হোটেল প্যালেস্টাইন” নামক একটা রেষ্টুরেন্টে নামি। কথা বলে জানতে পারলাম ফিলিস্তিনি মুসলমানদের সাথে একাত্মবোধ করে হোটেলের নাম দিয়েছেন প্যালেস্টাইন। ড্রাইভারসহ আমাদেরকে কফি ও কুলচা (কাশকাশ মেশানো স্পেশাল কাশ্মীরি বিস্কুট) খেতে দিয়েছেন। কিন্তু বিল নেননি। উনার কথা হলো, আমরা ক্যামেরা চার্জ দেওয়ার নিয়তে গিয়েছি, খাওয়ার জন্য যাই নি। তাই টাকা নিবেন না।

বুকিংডটকম, আগোড়াডটকম ও OYO’তে অনেক খোঁজেও গুলমার্গে বাজেট হোটেল পাচ্ছিলাম না। ড্রাইভারকে বলায় উনি মোটামুটি দামে হোটেল ম্যানেজ করে দেন। এসব বাংলাদেশে কল্পনাও করা যায় না।

এতোগুলো মানুষের ভীড়ে মাত্র একজন অটোওয়ালা ত্যাড়ামী করেছেন। সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় ভাড়া বেশি চেয়েছেন। কিন্তু পাশের ফল বিক্রেতা উনাকে বকা দেন। বলেছেন, “মেহমানদের থেকে বেশি চাও কেনো?”

নিরাপত্তা:

Kashmir

পুলাওয়ামা ক্রস করে পুলগাম এবং অনন্তনাগ হয়ে শ্রীনগর পৌঁছি। অনন্তনাগ পর্যন্ত ৪০০/৫০০ মিটার পর পর ইন্ডিয়ান আর্মি ও ডব্লিউএসজি কমান্ডোরা স্টেনগান নিয়ে টহল দেয়। শ্রীনগরের মোড়ে মোড়ে শুধু সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স (CRVF) সদস্যরা দাঁড়িয়ে থাকেন। গুলমার্গ, সোনমার্গ, বাতাব ভ্যালী, আরু ভ্যালী এসব জায়গায় যাওয়ার সময় নিরাপত্তা বাহিনীর কাউকে দেখা যায় না। আর্মির সাথে ঝামেলা হয় মূলত সাউথ কাশ্মীরে। কিন্তু ট্যুরিস্ট স্পটগুলো হচ্ছে নর্থ কাশ্মীরে যেখানে সিকিউরিটি নিয়ে বিন্দুমাত্রও চিন্তা করার অবকাশ নাই।

ভাষা :

কাশ্মীরি লোকজন নিজেদেরকে ইন্ডিয়ান কিংবা পাকিস্থানি মনে করে না। স্বতন্ত্র জাতি কাশ্মীরি হিসেবেই পরিচয় দেন। প্রধান ভাষা কাশ্মীরি। সবাই হিন্দি বলতে পারেন। হোটেলের রিসিপশনিস্ট, দোকানদার, ড্রাইভার, ফল বিক্রেতা যাদের সাথেই কথা বলেছি, ৬০/৭০ ভাগ লোক ইংরেজী বলতে পারেন। অনেকে তো বাংলাও বলতে পারেন। এখানে বেড়াতে আসলে ভাষার সমস্যা হওয়ার কথা না।

খরচ:

এয়ারে কিংবা ট্রেনে কে কীভাবে আসবে সেটা যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। মানুষজন বলে, কাশ্মীর ট্যুর নাকি অতিরিক্ত এক্সপেন্সিভ। কিন্তু এখানে থাকা-খাওয়া আমার কাছে মডারেট বলেই মনে হয়েছে। হরেকরকমের বিরিয়ানি পাওয়া যায়। প্রতি বেলায় ১৫০-২০০ রুপীতে উদরফূর্তি করা যায়। খাবার নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। সবই হালাল খাবার। ৮০০ রুপী দিয়ে মুঘল দরবারে কাশ্মীরি ওয়াজওয়ান প্লেটারটা নিলে চারজনে খেয়েও শেষ করা যাবে না। কাশ্মীরের প্রত্যেকটা খাবারই স্বাদে অনন্য।

আপেল, মাল্টা ওসব আমার কাছে বিরক্ত লাগে। টার্কিশ ফল এ্যপ্রিকোট, কিউই, ম্যাক্সমেলন, চেরী এসব দেশে পাওয়া যায় কিনা জানি না। অনেক খোঁজাখুজির পর চট্টগ্রামের খুলশীর সুপারস্টোর বাস্কেটে ড্রাই এ্যপ্রিকোট পেয়েছিলাম। কাশ্মীরে রাস্তার অলিগলিতে এসব ফল পাওয়া যায়।

কাশ্মীর পুরোটাই ট্যুরিজম নির্ভর জায়গা :

Kashmirকংডোরি পর্বতের ডান পাশে তাকালেই আযাদ কশ্মীর, উরি ও বারামোল্লা দেখা যায়। মেঘ এবং হিমবাহের কারণে ক্রিস্টাল ক্লিয়ার ভিউ না পেলেও আবার আসলে দেখা হবে বলে নিজেকে স্বান্তনা দিয়ে চলে এসেছি।

কাপড়-চোপড়ও সংস্কৃতির অংশ। একেক জনের পছন্দ একেক রকম। তবে কাশ্মীরিদের রুচি এতো ভালো যে এখানকার দোকানগুলোতে ঢুকলে কিনতে পারুন বা না পারুন, জিনিস পছন্দ করতেই হবে। বিশ্বখ্যাত জুতার ব্র্যান্ড এডিডাস, নাইকি, বন্ড স্ট্রীট, পিউমা, ওয়েইনব্রেনার, ব্র্যান্ডেড কাপড় যেমন-এইচএন্ডএম, বেয়ার, লিভাইস, বাফেলো, সান্তা বারবারা, ল্যাকোস্টে, পিটার ইংল্যান্ড, এ্যারো জিন্স সবই কাশ্মীরে পাওয়া যায়। কিন্তু দামটা একটু বেশি।

গতকাল (৯ জুন) সন্ধ্যায় “বাজরাঙ্গি ভাইজান” মুভিতে আদনান সামির গান গাওয়া আইশমাকামের সেই দরগায় গিয়েছিলাম। পৌঁছাতে রাত আটটা বেজে যাওয়ায় কাউকে ঢুকতে দিচ্ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশি বলায় আমাদেরকে ঢুকতে দিয়েছিল। কাশ্মীর ভ্যালী মুসলিম প্রধান এলাকা। জম্মু এবং লাদাখ যথাক্রমে হিন্দু ও বৌদ্ধ প্রধান এলাকা। কাশ্মীরে সরকারি মেডিকেল কলেজ আছে মাত্র দুইটা। আবার প্রাইভেট মেডিকেলে পড়াও এক্সপেন্সিভ। ফলে কাশ্মীরি স্টুডেন্টরা বাংলাদেশে পড়তে যায়। এখানকার ডাক্তারদের নামের নিচে ডিগ্রীর পেছনে ব্র্যাকেটে বাংলাদেশ লিখা থাকে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বাংলাদেশি মেডিকেলে পড়ার জন্য কনসালটেন্সি অফিসের বিজ্ঞাপন দেখা যায়। তাই বাংলাদেশি বললে এখানকার লোকজন খুবই সম্মান করে। মুসলমান বললে আরও বেশি খাতির যত্ন করে।

কোথাও গেলে দিনের ব্যস্ততার পর রাতের সুনসান নীরব রাস্তায় হাঁটতে ভালো লাগে। বাংলা আর ইংরেজী ছাড়া অন্য ভাষা পারি না। তাই ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টদের সাথে কথা বলে ওদের সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করি। নেপালে গিয়ে ত্রিভূবন ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টদের সাথে আড্ডার সময় গোরখা, কীরাটিদের সম্পর্কে জানতে পারি। হিন্দী বুঝতে পারলেও বলতে পারি না। তাই কাশ্মীরিদের সম্পর্কে আরেকটু ভালোভাবে জানার জন্য কাশ্মীর ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলাম। তামিম সাকিব এবং মুশফিকের দারুণ ভক্ত তারা। বাংলাদেশের ইতিহাস ও রাজনীতি নিয়েও ভালো দখল আছে।

গোলমার্গ ও সোনমার্গে সারাবছরই স্নো থাকে। তাই ঠান্ডা বেশি। নেটিভ কাশ্মীরিরাও উইন্টারে তিন মাসের জন্য জম্মু চলে যান। তবে শ্রীনগরের আবহাওয়া দারুণ ছিল। ডাল লেকের পাশে দিনে ১০/১২ কিলোমিটার করে হাঁটলেও ক্লান্তি আসে না। শরীর থেকে এক ফোঁটা ঘাম বের হয় না। এখানে আসার পর রাতে মাত্র চার ঘন্টা করে ঘুমিয়েছি। কখনোই ঘুম কম হয়েছে বলে মনে হয় নি। ভূস্বর্গের আবহাওয়া বলে কথা।

কাশ্মীরের সৌন্দর্য শুধু ট্যুরিস্ট স্পটগুলোতে নয় :

Kashmirএখানকার রাস্তাঘাট যতটা না কাশ্মীরিদের কথা মাথায় রেখে বানানো হয়েছে তার চেয়ে বেশি ফোকাস করা হয়েছে ইন্ডিয়ান মিলিটারি কনভয়’র জন্য।
কাশ্মীরে কোনো শিল্প কারখানা নাই। ইনকাম পুরোটাই ট্যুরিজম নির্ভর। স্থানীয়রা বলেন, “বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর ইন্ডিয়ান মিডিয়ার ব্ল্যাক প্রোপাগান্ডার কারণে ট্যুরিস্ট কমে গেছে।” কংগ্রেসই নাকি ভালো ছিলো।

দার্জিলিংএ বাংলাদেশীরা খুব সহজে হোটেল পায় না। এখানে ওসব সমস্যা নাই। হালাল খাবার নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। ভেজিটেরিয়ানদের জন্য “পাঞ্জাবী ধাবা” তো আছেই। অলিগলিতে মসজিদ। ভাষার সমস্যা নাই। মানুষজনের ব্যবহার অমায়িক। কাশ্মীর আসুন, দুনিয়াবি জান্নাতের এই রেপ্লিকাটাকে উপভোগ করুন। ইন্ডিয়ান আর্মি কর্তৃক ভূলুণ্ঠিত হওয়া এই কাশ্মীরিদের জীবন মানের উন্নয়নে ভূমিকা রাখুন। একবার কাশ্মীর এসে কয়েক বছর ভালোভাবে বেঁচে থাকার রসদ নিয়ে যান।

রাস্তার মাইল ফলকে লিখা আছে, Life is a journey, enjoy it. Accident has no holiday. কাশ্মীর উপত্যকা প্লাস্টিক ফ্রি এরিয়া। কোথাও একটা চিপ্সের প্যাকেটও দেখা যায় না। ঘুরতে এসে আবর্জনা ফেলবেন না।

সমস্যা:
এখানে ইন্ডিয়ান প্রিপেইড সিমের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। পোস্টপেইড সিম দিয়ে কাজ চালাতে হয়। এদিকে ট্যুরিস্ট ভিসায় পোস্টপেইড সিম কেনা যায় না। আবার কাশ্মীরে বিদেশীদের কাছে সিম বিক্রি করে না। তাই ইন্টারনেটের একমাত্র উৎস হলো হোটেল/রিসোর্টের ওয়াইফাই। তবে চাইলেই স্থানীয় লোকজন মোবাইলের হটস্পট দেয়। ইন্টারনেট এতো রেস্ট্রিকটেড হওয়ার পরও আর্মিরা ক্র্যাকডাউন চালানোর সময় বন্ধ করে দেয়।

লেখক : সাবেক শিক্ষার্থী, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

মুক্ত ক্যাম্পাস/জুয়েল/রানা

পূর্ববর্তী নিবন্ধকামরুল হাসান হৃদয়ের কবিতা
পরবর্তী নিবন্ধটেকনাফে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত ৩