একটি দিবসের গল্প

জুনাইদ আল হাবিব:
বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০১৯ | ৯:১২ অপরাহ্ণ | 147 বার পঠিত

বাংলাদেশ একটি দুর্যোগ ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। দুর্যোগের এ ঝুঁকিটা বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। উপকূল অঞ্চল লন্ডভন্ড হয়, তৈরি হয় বিরাণ ভূমিতে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন একটি ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের নাম ‘ভোলা সাইক্লোন’। যাতে অন্তত ৫ লাখেরও বেশি মানুষ মারা যায়। সরকারি হিসেবে যদিও সংখ্যাটা ৫ লাখ, কিন্তু বেসরকারি সূত্র বলছে, প্রাণহানির এ সংখ্যাটা ১০ লাখেরও অধিক।

ঘূর্ণিঝড়টিকে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড় হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও)। ২০১৭ সালের ১৮মে সংস্থাটি বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড়ের শীর্ষে এটির তালিকা প্রকাশ করে। যেটি ‘সিম্পসন স্কেলে ক্যাটাগরি ৩ মাত্রার’ ভয়াল ঘূর্ণিঝড়টি ১১ নভেম্বর রাতে ঘণ্টায় ১৮৫ কিলোমিটার সর্বোচ্চ গতিবেগে দেশের উপকূলে আঘাত হানে।

দিনটিকে বিশেষভাব স্মরণ করার জন্য বাংলাদেশে গত ৩ বছর ধরে পালিত হয়েছে উপকূল দিবস। ” উপকূল বাংলাদেশ” নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ডাকে ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো পালিত হয় দিবসটি। যা প্রথম বছরেই ব্যাপক সাড়া পায়। যা এবার তৃতীয় বছরে পা রাখলো। প্রথম বছর ২০১৭সালে দিবসটি পালন হয় উপকূলের ৩৪টি স্থানে, তার পরের বছর ২০১৮ সালে ৫৩টি স্থানে এবং এবার ২০১৯ সালে দিবসটি পালিত হয়েছে ৬০টি স্থানে। প্রথম বছরেই দিবসটি নিয়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। আস্তে আস্তে দিবসটি পালনে উপকূলের মানুষের মধ্যে প্রচন্ড আগ্রহের সৃষ্টি হয়।

দিবসের জন্য আন্দোলন, ইতিহাসে খুবই বিরল একটি ঘটনা। উপকূলের জন্য একটি দিবসের দাবি উঠে। দেশে বহু দিবস আছে। কিন্তু এত দিবসের ভিড়ে কেন উপকূল দিবসের দাবি?

বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল সব সময় অবহেলিত থাকে। স্বাভাবিক সময়েও উপকূলের মানুষের জীবনটা পড়ে রয় অস্বাভাবিক। কিন্তু উপকূলের এ মানুষগুলোর কথা বলার জন্য নেই কোন বিশেষ দিন। ফলে, সব সময় উপকূলের মানুষের কণ্ঠ উঠে আসে না কেন্দ্রে।

কিভাবে উপকূল দিবসের স্বপ্ন বুনন হয়:

রফিকুল ইসলাম মন্টু। বাংলাদেশের উপকূল সাংবাদিকতার পথিকৃত। কাজের বিস্তৃতি পরিধি সূত্রে ভূষিত হয়েছেন ‘উপকূল বন্ধু’ উপাধিতে। উপকূলে কাজ করতে গিয়ে উপকূল নিয়ে নিজের ভেতর জমা হয় বহু ধরণের অভিজ্ঞতা। খুঁজতে থাকেন উপকূলের জন্য একটি দিন চাই। কোন দিনটি হবে উপকূলের জন্য একটি বিশেষ দিনে। ভাবতে ভাবতে খুঁজে পান ১২নভেম্বর। এ দিন ১৯৭০সালে বাংলাদেশের উপকূলের মানুষের জন্য সবচেয়ে কালো দিন। যে দিন ৫ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন ঘূর্ণিঝড়ের কবলে। সিদ্ধান্ত নিলেন দিনটিই হতে পারে উপকূলের মানুষের কথা বলার জন্য বিশেষ একটি দিন। তারপর তিনিই সর্বপ্রথম ‘১২ নভেম্বর হোক উপকূল দিবস’ শিরোনামে উপকূল দিবসের প্রস্তাব তুলে লেখালেখি শুরু করেন মূল ধারার গণমাধ্যমগুলোতে। গড়ে তোলেন ‘উপকূল দিবস বাস্তবায়ন কমিটি’। প্রথমবার উপকূলের ৩৪টি স্থানে বাস্তবায়ন করেন দিবসটি। যা এবার পালিত হয়েছে উপকূলের ৬০টি স্থানে। কেবল তাই নয়, দিবসটি যাতে সরকারের নজরে আসে সেজন্য জাতীয় প্রেসক্লাবে দু’জন সাংসদ এবং বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞদের নিয়ে জাতীয় পর্যায়ের গোল টেবিল আলোচনা এবং মানববন্ধনের আয়োজন করেন।

উপকূল দিবসের ভাবনাটা কেন, কিভাবে মাথায় আসলো? বলছিলেন রফিকুল ইসলাম মন্টু, ‘উপকূল দিবসের ভাবনাটা আসে উপকূলের কাদামাটিতে বসেই; সঙ্গে তখন উপকূলের মানুষেরা। একজন সংবাদকর্মী হিসাবে আমি বাংলাদেশের গোটা উপকূলীয় অঞ্চল নিয়ে কাজ করি। আমার মনে হলো, একটা দিবসের সঙ্গে উপকূলের বিষয়গুলো যুক্ত করতে পারলে উপকূলবাসীর অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজটি আরও সহজ হতো। ভাবতে থাকি, কোন দিনটিকে ‘উপকূল দিবস’ হিসাবে প্রস্তাব করা যায়। এমন দিবস ঠিক করতে হবে, যা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়। অনেক ভেবেচিন্তে বের করি ১২ নভেম্বর। ১৯৭০ সালের এইদিনে উপকূল অঞ্চলের ওপর দিয়ে যে প্রলয় বয়ে গিয়েছিল; সেটাই পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাণঘাতি। ১২ নভেম্বরকে উপকূল দিবস প্রস্তাব করে আমি সংবাদপত্রে লেখা শুরু করি ২০১৬ সালে। ২০১৭ সাল থেকে প্রথমবারের মত উপকূল দিবস পালিত হয় উপকূলজুড়ে। প্রথম বছরেই অনন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকাসহ দেশীয় সংবাদ মাধ্যমে এ বিষয়টি ব্যাপকভাবে কাভারেজ পায়। ২০১৮ সালের আরও বর্ধিত পরিসরে রাজধানী ঢাকাসহ উপকূলের ৫৩ স্থানে দিবসটি পালিত হয়।

এবার ২০১৯ সালে ঢাকাসহ উপকূলের ৬০ স্থানে দিবসটি পালিত হচ্ছে। উপকূলের দিকে গণমাধ্যম ও নীতিনির্ধারকদের নজর বাড়িয়ে উপকূলবাসীর জীবনমান উন্নয়ন ঘটানোই উপকূলের জন্য একটি দিবস প্রস্তাবের মূল লক্ষ্য। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে উপকূল নিয়ে নিবিড়ভাবে রিপোর্টিং করতে গিয়ে আমি উপকূল দিবসের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করি। দিবস থাকলে উপকূল ভাবনা সবার মাঝে দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল, সংবাদ মাধ্যম থেকে শুরু করে সকল মহলে উপকূল-ভাবনার সুযোগ বাড়বে।

সম্প্রতি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ড. এনামুর রহমান দিবসটির রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির আশ্বাস দিয়েছেন। দিবসটি বাস্তবায়নের প্রস্তাব তিনি মন্ত্রী পরিষদে তুলবেন। এজন্য তাকে বিশেষ ধন্যবাদ জানাই। আমরা উপকূলবাসী আশাকরি, দ্রুত দিবসটি পালনের মাধ্যমে উপকূলের মানুষের কণ্ঠ কেন্দ্রে গুরুত্বসহকারে প্রতিফলিত হবে।

মুক্ত ক্যাম্পাস/জুনাইদ/এমআর

পূর্ববর্তী নিবন্ধপঞ্চগড়ে হিন্দু ছাত্র ভর্তি হলো মাদ্রাসায়
পরবর্তী নিবন্ধসংসদে জাতির কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইলেন রাঙ্গা