চলে গেলেন নারীনেত্রী আয়েশা খানম

অনলাইন ডেস্ক
শনিবার, ০২ জানুয়ারি ২০২১ | ৬:১০ অপরাহ্ণ
চলে গেলেন নারীনেত্রী আয়েশা খানম

ক্যানসারের সঙ্গে দীর্ঘদিন লড়াই করে অবশেষে না ফেরার দেশে চলে গেলেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আয়েশা খানম (ইন্না লিল্লাহি … রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। শনিবার ভোরে রাজধানীর বিআরবি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন নারী অধিকার আন্দোলনের এই অন্যতম পুরোধা।

শনিবার নেত্রকোনায় নিজ গ্রামে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে স্বামী মরতুজা হাসানের কবরের পাশে আয়েশা খানমকে সমাহিত করা হয়। এ সময় তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ’গার্ড অব অনার’ দেওয়া হয়। প্রয়াত আয়েশা খানমের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, ডেপুটি স্পিকার মো. ফজলে রাব্বী মিয়া, চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন। পৃথক শোকবার্তায় তারা মরহুমার আত্মার মাগফিরাত কামনা এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবার-পরিজন, গুণগ্রাহী ও শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।

শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আয়েশা খানম ছিলেন একজন সাহসী যোদ্ধা। দেশে নারীর ক্ষমতায়নে তিনি অত্যন্ত প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছেন। তার অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আয়েশা খানমের মৃত্যুতে দেশের নারী সমাজ একজন অকৃত্রিম বন্ধু ও সাহসী সহযোদ্ধাকে হারাল।

ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সহসভাপতি আয়শা খানম বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনসহ স্বাধীনতা যুদ্ধের সব আন্দোলন-সংগ্রামে সামনের সারিতে ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নিজেকে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যুক্ত করেন আয়েশা খানম। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের নির্যাতনের শিকার নারীদের পুনর্বাসন এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের সহায়তায় কাজ করেন।

২০০২ সাল থেকে ৬৮টি সংগঠনের প্ল্যাটফরম সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির সেক্রেটারিয়েটের নেতৃত্ব প্রদান করে আসছিলেন এই নারীনেত্রী। শুরু থেকেই বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আয়েশা খানম। প্রথমে ছিলেন সহসাধারণ সম্পাদক, দশক কাল আগে সভাপতি নির্বাচিত হন এবং আমৃত্যু এই পদে ছিলেন।

তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু জানান, বীর মুক্তিযোদ্ধা আয়েশা খানম দীর্ঘদিন ফুসফুসের ক্যানসারের সঙ্গে লড়ছিলেন। শনিবার ভোররাতে ঢাকার নিজ বাসায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে রাজধানীর বিআরবি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকরা তার মৃত্যুর খবর জানান।

১৯৪৭ সালের ১৮ অক্টোবর নেত্রকোনার গাবড়াগাতি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আয়েশা খানম। তার বাবার নাম গোলাম আলী খান, মা জামাতুন্নেসা খানম। ছাত্রজীবন শেষে বঞ্চিত নারীদের অধিকার আদায়ে আমৃত্যু নিয়োজিত ছিলেন আয়েশা খানম। পাকিস্তান আমলে হামদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বাতিলের দাবিতে ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে পা রাখেন তিনি। ১৯৬৬ সাল থেকে ছাত্র আন্দোলনে পুরোপুরি সক্রিয় হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় রোকেয়া হল ছাত্র সংসদের সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন ছাড়াও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং মহান মুক্তিযুদ্ধসহ সব প্রগতিশীল আন্দোলনের সক্রিয় সংগঠক ছিলেন। ১৯৭১ সালে ছাত্র ইউনিয়নের সহসভাপতি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে ঢাকায় শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করতেও কাজ করেছেন। ডামি রাইফেল হাতে ঢাকায় নারী শিক্ষার্থীদের মিছিলের যে ছবিটি আলোচিত, তাতে আয়েশা খানমও ছিলেন।

ডয়চে ভেলে বাংলায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আয়েশা খানম জানান, এপ্রিলের শেষ দিকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলায় যান তিনি। সেখানে কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত শরণার্থী শিবির ও মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ক্রাফটস হোস্টেলে ওঠেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে যারা ভারতে আসতেন, তাদের এক অংশের সাময়িক আবাসস্থল ছিল ক্রাফটস হোস্টেল। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থী শিবিরগুলোয় সশরীরে উপস্থিত হয়ে যোদ্ধাদের মনোবল অটুট রাখা, প্রণোদনা দান এবং শরণার্থীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগাতে কাজ করেন তিনি। ডয়েচে ভেলেকে তিনি আরও বলেন, আগরতলায় চিকিৎসাসেবার ওপর আমি প্রাথমিক একটা প্রশিক্ষণ নিই। এর পর আগরতলার প্রতিটি ক্যাম্পে গিয়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সহায়তা দিতে আত্মনিয়োগ করি। এ ছাড়া বিভিন্ন অভিযানে মুক্তিযোদ্ধাদের পাঠানোর আগে তাদের জন্য সংক্ষিপ্ত ওরিয়েন্টেশনের ব্যবস্থা করা হতো। সেখানে তাদের ওরিয়েন্টেশন দেওয়ার কাজ করতাম। এ ছাড়া ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বক্তৃতা দেন আয়েশা খানম। ছাত্রনেত্রী হিসেবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাধিকার আন্দোলনের পক্ষে জনমত গড়ে তোলা ও সচেতনতার কাজেও সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন তিনি।

আয়েশা খানমের মৃত্যুতে গভীর শোক ও শ্রদ্ধা জানিয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও নেতারা। তার মরদেহ সকাল সাড়ে ৮টায় রাজধানীর সেগুনবাগিচাস্থ বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নেওয়া হয়। সেখানে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটি, ঢাকা মহানগর কমিটি, সংগঠনের নারায়ণগঞ্জ শাখা ও বেলাবো শাখা শ্রদ্ধা নিবেদন করে। পাশাপাশি সংগঠনের কর্মকর্তারা তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানান। এ সময় সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির পক্ষে দীপ্ত ফাউন্ডেশনের জাকিয়া কে হাসান, নারী প্রগতি সংঘের শাহনাজ সুমী, সেভ দ্য চিলড্রেনের উম্মে সালমা, নারী মুক্তি সংসদের সাবিকুন্নাহার, নারীপক্ষের শিরিন হক, দলিত নারী ফোরামের মনি রানী দাশ, ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র এবং হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, ঐক্য-ন্যাপ, মণি সিংহ-ফরহাদ ট্রাস্ট, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নারী সেলের প্রতিনিধিরা শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। এ ছাড়া রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রয়াত নেত্রীকে শ্রদ্ধা জানান। শোক প্রকাশ করেন অ্যারোমা দত্ত এমপি, রাশেদা কে চৌধুরী, সালমা আলী, মাহফুজা খানম, তপতী সাহা প্রমুখ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধডিপিএড কোর্সে ভর্তির মেয়াদ বাড়ল ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত
পরবর্তী নিবন্ধনারীনেত্রী আয়শা খানমের মৃত্যুতে ঢাবি উপাচার্যের শোক