তথ্যের অধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার নজিরবিহীন দমন: আর্টিকেল নাইনটিন

প্রেসবিজ্ঞপ্তি
রবিবার, ০৩ মে ২০২০ | ১১:০৫ অপরাহ্ণ | 198 বার পঠিত
তথ্যের অধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার নজিরবিহীন দমন: আর্টিকেল নাইনটিন

কোভিড-১৯ (করোনা ভাইরাস) মহামারি মোকাবেলায় নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে সমন্বয়হীনতা, কর্মপরিকল্পনায় অস্বচ্ছতা ও জবাবদিহির প্রকট অভাব বাংলাদেশে এই সঙ্কটকে গভীরতর করছে। একই সঙ্গে তথ্যের অধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা শিকার হচ্ছে নজিরবিহীন দমন-পীড়নের। কোভিড-১৯ এর চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় অস্বচ্ছতা ও এর মান নিয়ে প্রশ্ন তোলায় খোদ স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরাই প্রশাসনিক হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। একদিকে সাংবাদিকরা যখন ত্রাণ বিতরণে ব্যাপক অনিয়মের খবর তুলে ধরছেন, অন্যদিকে সরকার তখন করোনা সংক্রান্ত তথ্য জানার সুযোগ সাংবাদিকদের জন্য আরও সীমিত করছে। উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলার নামে সমালোচনাকারীদের কণ্ঠরোধে ব্যবহার করা হচ্ছে বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০২০। প্রকৃত গুজব প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবর্তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিন্নমত প্রকাশকারীদের ওপর খড়গহস্ত হচ্ছে সরকার।

“বাংলাদেশে কোভিড-১৯: তথ্যের অধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা পরস্থিতির বিশ্লেষণ” শীর্ষক প্রতিবেদনে এই উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আর্টিকেল নাইনটিন। বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস ২০২০ (ওয়ার্লড প্রেস ফ্রিডম ডে, ৩ মে) উপলক্ষে ০২ মে অনলাইনে আয়োজিত ’ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া ফোরাম’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে আর্টিকেল নাইনটিন বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল ওই প্রতিবেদেনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। বাংলাদেশ সময় রাত আটটায় আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ব্রাজিল, যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশ থেকে মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক ও গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা যুক্ত ছিলেন। এতে আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন যুক্তরাজ্যে আর্টিকেল নাইনটিনের আন্তর্জাতিক কার্যালয়ের আইন ও নীতি বিভাগের জ্যেষ্ঠ পরিচালক বারবোরা বোকুভস্কা, আর্টিকেল নাইনটিন ব্রাজিলের আঞ্চলিক পরিচালক ডেনিস ডোরা, বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক ও প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান।

অনুষ্ঠানে বলা হয়, আর্টিকেল নাইনটিন বাংলাদেশে করোনা প্রস্তুতির শুরু থেকে এ সংক্রান্ত পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। দেশে করোনা ভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। আর্টিকেল নাইনটিনের প্রতিবেদনে ৮ মার্চ থেকে ৮ এপ্রিল পর্যন্ত এক মাসের করোনা পরিস্থিতির মূল্যায়ন করা হয়েছে। এসময়ের মধ্যে মত প্রকাশ, তথ্যের অধিকার ও স্বচ্ছতা, ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম, সাংবাদিকদের প্রতি সহিংসতাসহ এমন ২০টি ক্যাটাগরিতে মোট ১৫৭ টি ঘটনা পর্যবেক্ষণ ও রেকর্ড করা হয়। এসব ঘটনায় আক্রান্ত/ভূক্তভোগী/ অধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন মোট ১৭৪ জন। শুধু মতপ্রকাশজনিত অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে ৪১টি। এসব ঘটনায় আক্রান্ত/ভূক্তভোগীর সংখ্যা ১৩৯জন, যাদের বেশিরভাগই সাধারণ ফেসবুক ব্যবহারকারী। (অনুগ্রহ করে বিজ্ঞপ্তির নীচের অংশে প্রতিবেদনের উল্লেখযোগ্য দিক দেখুন)

অনুষ্ঠানে ফারুখ ফয়সল বলেন, ‘’এটা ইতোমধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, স্বচ্ছতার অভাব, স্বাধীন মত প্রকাশে বাধা ও তথ্যের অবাধ প্রবাহে নিয়ন্ত্রণ করোনাভাইরাসকে বিশ্বজুড়ে দ্রুত ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করেছে এবং কোটি মানুষের জীবনকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। বাংলাদেশে এই সঙ্কটের শুরু থেকেও আমরা একই চিত্র দেখছি। করোনা ইস্যুতে স্বাধীন মতের দমন, তথ্য গোপনের মানসিকতা, সংক্রমণ প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ে নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে অদূরদর্শীতা, অস্বচ্ছতা ও সমন্বয়হীনতা এবং কোভিড-১৯ চিকিৎসায় চরম অব্যবস্থাপনা এর কারণ বলে আমরা মনে করছি।’’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দৈনন্দিন ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার সুযোগ বন্ধ করার সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করে ফারুখ ফয়সল বলেন, ‘’এটি দিন শেষে কোন ভাল ফল বয়ে আনবে না। এতে সাধারণ মানুষের উদ্বেগ বাড়ছে।’’

তিনি ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার সুযোগ দেয়া, করোনা শনাক্তকরণ কিটের তথ্য, কেন্দ্রভিত্তিক নমুনা পরীক্ষার দৈনিক হিসাব, পিপিইর মজুদ ও বিতরণসহ সমস্ত তথ্য উন্মুক্ত করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

ডিজিটাল অধিকারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বারবোরা বুকোভস্কা বলেন, এই সময়ে কেবল তথ্য জানার জন্যই নয়, মানুষে মানুষে যোগাযোগ ও মিথস্ক্রিয়া বাড়ানোর জন্যও ইন্টারনেটে প্রবেশগম্যতা থাকা প্রয়োজন। শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক অধিকার ভোগের জন্যও এটা এখন জরুরি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে ইন্টারনেট সেবা ততটা উন্নত নয় এবং পল্লী এলাকাগুলো মানসম্মত ইন্টারনেট সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার- সেখানে ডিজিটাল অধিকার নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক।’’

কার্যকরভাবে কোভিড-১৯ মোকাবেলার জন্য ডেনিস ডোরা পাঁচটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিতে সব সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। এগুলো হলো- সব ধরনের তথ্যে সাধারণ মানুষের প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করা, আইনের শাসন, কার্যকর জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা, পৃষ্ঠপোষকতাসহ বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক গবেষণার স্বাধীনতা এবং উন্নত জীবনমান নিশ্চিত করা। তিনি বলেন, নানা চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও ব্রাজিলের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাটি এখনো কার্যকর। তবে অন্য চারটি ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার উল্টোপথে চলছে।

কাজী রিয়াজুল হক মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ, আইন ও সংবিধানে যে বিধানের উল্লেখ আছে তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বিদ্যমান নীতি-কৌশলের ত্রুটি বের করার সুযোগ না দিলে সমাজ এগোতে পারবে না। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যেসব সহিংসতা হচ্ছে তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য না। সাধারণ ছুটির মধ্যে সব গার্মেন্টস চালু করার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, জীবিকার জন্য অর্থনীতিও সচল রাখতে হবে, তবে তা করতে হবে ধীরে ধীরে।

সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান বিদ্যমান শ্রম আইনের আওতায় ’কোভিড-১৯’ কে পেশাগত রোগ ঘোষণা করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, এটি করা হলে গার্মেন্টস শ্রমিক, অন্য পেশাজীবি ও কর্মরত সাংবাদিকরা পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় স্বাস্থ্য সুরক্ষার আইনগত অধিকার পাবেন, রোগাক্রান্ত হলে ছুটি, চিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণ পাবেন।

বক্তারা সবাই একমত পোষণ করেন যে, নৃতাত্ত্বিক, ধর্মীয়, জেন্ডার, পেশা ইত্যাদি বিবেচনায় সকল সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এই মহামারীর সময়ে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি, বৈষম্য ও বিদ্বেষমূল বক্তব্যের শিকার। এই বৈশ্বিক মহামারী মোকাবেলায় অন্তর্ভূক্তিমূলক ও সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য তারা সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

প্রতিবেদনের উল্লেখযোগ্য দিক:

১. আর্টিকেল নাইনটিন ৮ মার্চ ২০২০ মাস থেকে ৮ এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত মোট ২০টি ক্যাটাগরিতে মোট ১৫৭টি ঘটনা রেকর্ড করেছে।

২. এসব ঘটনায় আক্রান্ত/ভূক্তভোগী/ অধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন মোট ১৭৪ জন

৩. শুধু মতপ্রকাশজনিত অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে ৪১টি। এসব ঘটনায় আক্রান্ত/ভূক্তভোগীর সংখ্যা ১৩৯জন, যাদের বেশিরভাগই সাধারণ ফেসবুক ব্যবহারকারী।

৪. ত্রাণ বিতরণে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে উঠেছে- আলোচিত এমন ২৬টি ঘটনায় জড়িত ছিলেন ৪৫ জন, যাদের সিংহভাগেরই সরকারি দলের সাথে সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।

৫. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মত প্রকাশের জন্য মামলা হয়েছে ২৫ জনের নামে। ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ’গুজব’ ছড়ানের অভিযোগে গ্রেফতার ও জরিমানা করা হয়েছে ৫৪ জনকে।

৬. করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকে এর প্রাদুর্ভাব এবং বিপদ সম্পর্কে সর্তক করা ১১ জন ‘হুইসেল ব্লোয়ারকে’ গ্রেপ্তার ও হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে।

৭. ২৫টি ফেসবুক একাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। আরও ৫০টি ফেসবুক একাউন্ট বন্ধের জন্য বিটিআরসিকে অনুরোধ করেছে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী। এছাড়াও নজরদারির মধ্যে রয়েছে ১০০ একাউন্ট ও ফেসবুক।

৮. সুনির্দিষ্ট সংখ্যা উল্লেখ না করেই ’গুজব’ ছড়ানো ও ’অপপ্রচারের’ অভিযোগে অনেকগুলো অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও ওয়েবসাইট বন্ধের কথা জানায় সরকার। বন্ধ হওয়া পোর্টালগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- ‘বেনারনিউজ, ‘এখনসময়’, ’নেত্রনিউজ’ ও ‘বিডিকরোনাডটওয়ার্ডপ্রেস’।

৯. ত্রাণ বিতরণে হওয়া অনিয়ম নিয়ে প্রতিবেদন করায় ও করোনা সংশ্লিষ্ট সংবাদ সংগ্রহকালে আটটি ঘটনায় মোট ১১জন সাংবাদিক হামলা, মামলা ও সহিংসতার শিকার হয়েছেন।

১০. বিভিন্ন অনলাইন পোর্টাল ও ফেসবুক আইডি ব্যবহার করে করোনা ভাইরাস সম্পর্কে কমপক্ষে ১৩ ধরনের ভুয়া খবর বা ফেক নিউজ প্রচার করা হয়েছে। ভুয়া খবর, ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য মোকাবেলায় সরকারের কার্যকর কোন উদ্যোগ দৃশ্যমান ছিল না।

১১. করোনা সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে আছেন রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞার কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে গুজব, ভুল ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে।

১২. করোনার প্রাদুর্ভাবে ২১টির বেশি জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিক সংবাদপত্রের মুদ্রণ সংস্করণ বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া সিলেট, যশোর, হবিগঞ্জ ও রংপুরের প্রায় সব স্থানীয় পত্রিকার প্রকাশনা স্থ‌গিত করা হয়েছে।

যে ২০টি ক্যাটাগরিতে ঘটনা রেকর্ড ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে সেগুলো হলো- মতপ্রকাশের স্বাধীনতার লঙ্ঘন, হুইসেল ব্লোয়ার, করোনা বিষয়ক সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা, করোনা বিষয়ে মতপ্রকাশের জন্য সাংবাদিক গ্রেপ্তার এবং আটক, করোনা সম্পর্কিত পোস্ট ব্লকিং এবং ফিল্টারিং, তথ্যের দমন/গোপন, স্বচ্ছতার অভাব, ভুয়া খবর, ভুল তথ্য, বিদ্বেষমুলক বক্তব্য, করোনায় আক্রান্ত রোগীদের প্রতি বিরূপ/বৈষম্যমূলক আচরণ (স্টিগমা), রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি বিরূপ / বৈষম্যমূলক আচরণ (স্টিগমা), সৎকারে বাধা, ত্রাণ সংগ্রহকালে দরিদ্র লোকদের উপর লাঞ্ছনা/ হয়রানি/ পুলিশি হামলা, ত্রাণ বিতরণে দুর্নীতি, সাধারণ রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে অস্বীকার, করোনার কারণে সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুতি, ওয়েবসাইট ব্লক, করোনা আক্রান্ত সাংবাদিক এবং করোনার কারণে সংবাদপত্রের মুদ্রণ সংস্করণ স্থগিত।

আমাদের সাথে ফেসবুক পেজে কানেক্ট থাকুন: মুক্তক্যাম্পাস

মুক্ত ক্যাম্পাস/জেডআর

পূর্ববর্তী নিবন্ধদক্ষিণ কোরিয়ায় শিথিল হচ্ছে সামাজিক দূরত্ব
পরবর্তী নিবন্ধজাবিতে নিরাপত্তা কর্মকর্তার হাতে শিক্ষক লাঞ্চিত