বাবা হিসাবে ফাগুনকে নিয়ে লিখতে এখন আর ভালো লাগে না, লাগছে না। কী লিখবো। লিখবো, আজ একমাস হতে চললো, ফাগুনের মৃত্যুরহস্য রহস্যই রয়ে গেছে। লিখবো, প্রতিদিন আমি আর ওর মা কবরের পাশে বসে অশ্রু ঝরাই। যেটা আমাদের রুটিন ওয়ার্ক হয়ে গেছে। আর কী লিখবো! লিখবো কী প্রতিরাত আমাদের কাটে প্রায় নির্ঘুম। মনে হয় ওই তো ফাগুন, দরোজায় টোকা দিয়ে বলবে, আব্বুজি-মম, আমি এসে গেছি।
কাল ‘বাবা দিবস’ ছিল। আমি ময়মনসিংহে একটি সেমিনারে ছিলাম সারাদিন। যাব না ভেবেছিলাম, কিন্তু ‘বাবা দিবস’টি এড়িয়ে যেতে ইচ্ছা করেই গিয়েছিলাম। বাবা দিবসে রাত বারোটার পর আমাকে ‘উইশ’ করা হতো না ফাগুনের। বেশিরভাগ সময়ে সকালে ‘উইশ’ করতো। আস্তে করে বলতো, ‘আব্বুজি, হ্যাপি ফাদারস ডে’। আমার এই ‘ফাদারস ডে’তে ‘হ্যাপি’ হওয়া সম্ভব নয় বলেই সকাল সাতটায় বাড়ি ছেড়েছিলাম, পালিয়েছিলাম ময়মনসিংহের পথে। এত সকালে না গেলেও চলতো, তবু পালাতে তো হবে।
সেমিনারে আলোচনায়, এমন কী নিজের বক্তৃতাতেও মন বসাতে পারিনি। একধরণের ঘোরের মধ্যে ছিলাম। যখনই সেলফোনে রিং বা নোটিফিকেশন টোন বাজছিল চমকে উঠছিলাম। ফাগুন কি? ভুলে যাচ্ছিলাম ওই নম্বর থেকে কেউ আর বলবে না, ‘আব্বুজি, হ্যাপি ফাদারস ডে’। আমাকে সারা জীবনের মতন ‘আনহ্যাপি’ করে চলে গেছে তরুণ তুর্কি ‘ইহসান ইবনে রেজা ফাগুন’। না, ইচ্ছে করে যায়নি সে। তাকে যেতে বাধ্য করা হয়েছে, তাকে মেরে ফেলা হয়েছে।
সাংবাদিকতায় আমার উত্তরসূরি, বাবার ততোধিক যোগ্য পুত্র। হ্যাঁ, আমার থেকেও অনেক যোগ্য ছিলো যে। যার অযোগ্য পিতা আমি। এমন একটা দেশে তাকে রেখেছিলাম, যে দেশ তার জীবনের নিরাপত্তা দিতে পারেনি। হোমড়া-চোমড়াদের মতন কানাডা-মালয়েশিয়া-অস্ট্রেলিয়াকে সেকেন্ড হোম বানিয়ে সেখানে পাঠিয়ে দিতে পারতাম, তাহলে হয়তো কাল শুনতে পেতাম, ‘ আব্বুজি, হ্যাপি ফাদারস ডে’।
হায়, একজন তরুণ সাংবাদিক, যে কিনা বাড়ি ফিরতে গিয়ে লাশ হলো। রেললাইনের পাশে পড়ে রইলো তার দেহ। যাকে চিহ্নহীন করার চেষ্টা করা হলো। বেওয়ারিশ হিসাবে দাফনের চেষ্টা হলো। এক মাস প্রায় হয়ে যাচ্ছে, তার খুনিদের ধরা তো দূরের কথা, রহস্যটার বিন্দুমাত্র উদঘাটন হলো না। রাষ্ট্র অনেকটাই নির্বিকার রইলো। এমন অবস্থায় আমাদের মতন পিতাদের কিসের ‘ফাদারস ডে’। আমাদের মতন পিতা-মাতার সকল দিনই তো এখন ‘টিয়ারস ডে’, ‘অশ্রু দিবস’।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
মুক্ত ক্যাম্পাস/জেডআর