আত্মহত্যা প্রতিরোধে চাই মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন

শাহীন আলম
সোমবার, ১৫ মার্চ ২০২১ | ৮:০৩ অপরাহ্ণ
গল্পটি রূপকথার নয়

‘মায়ের সাথে অভিমানে ইবি শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা’ চলতি বছরের ২রা জানুয়ারি সংবাদ পত্রে প্রকাশিত একটি শিরোনাম। ব্যক্তি-নাম ভূমিকার পরিবর্তনে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে আত্মহত্যা। তাই বর্তমানে বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্বে আত্মহত্যা ও আত্মহত্যার প্রবণতা একটি গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য সমস্যা। আমাদের দেশেও প্রতি বছর প্রায় ১০ হাজারের বেশী মানুষ আত্মহননের পথ বেঁছে নেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, বিশ্বে প্রতি বছর আট লাখের অধিক এবং প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন আত্মহত্যা করেন ও অসংখ্য মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। যাদের প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে মানসিক রোগী। বর্তমান বৈশ্বিক মহামারি করোনা কালে অর্থনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক সকল ক্ষেত্রেই মানসিক চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এমতাবস্থায় সর্বোচ্চ মানসিক ঝুঁকিতে রয়েছে শিশু ও তরুণ-তরুণীরা। জাতীয় মানসিক ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে বিভিন্ন মানসিক রোগে আক্রান্ত মানুষ শতকরা ৩১ শতাংশ যা মোট জনসংখ্যার হিসাবে প্রায় ৫ কোটি। অথচ রোগীর হিসাবে প্রায় ৭০ হাজার জনের জন্য রয়েছেন একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ১৫-৪৪ বছর বয়সী জনগোষ্ঠীর মৃত্যুর প্রধান তিনটি কারণের একটি হলো আত্মহত্যা। সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, জার্মানি, স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চল ও এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে জাপানে আত্মহত্যার হার সর্বোচ্চ; লাখে ২৫ জনের ওপরে। এদিকে গবেষকরা বলছেন, গত ৫০ বছরে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আত্মহত্যার হার বেড়েছে শতকরা ৬০ শতাংশ এবং বিশ্বের মোট আত্মহত্যা সংখ্যার ২.০৬ শতাংশ বাংলাদেশী। সেই হিসাবে প্রতি বছর লাখে আমাদের দেশে ১২৮ জনেরও অধিক মানুষ আত্মহত্যা করে থাকেন; যা প্রতি বছরেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে সারা বিশ্বে নারীদের তুলনায় পুরুষের আত্মহত্যার হার তিন গুণ বেশি হলেও বাংলাদেশে নারীর আত্মহত্যার হার অধিক। দেশে প্রতিদিন গড়ে ২৮ জন আত্মহত্যা করে যাদের অধিকাংশই ২১-৩০ বছর বয়সী নারী ও আত্মহত্যার ঝুঁকিতে থাকা ৬৫ লাখ মানুষের অধিকাংশই অল্প বয়সী এবং এর ৮৯ শতাংশই নারী।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, মূলত চার ধরনের মানুষ আত্মহত্যার পথ বেঁছে নেয়- ব্যক্তি জীবনে অতিরিক্ত নিয়ম মানা, একদমই নিয়ম না মানা, অনেক বেশি সামাজিক এবং সমাজচ্যুত ব্যক্তিরা। তবে আত্মহত্যার ধরন মূলত ইমপালসিভ বা হঠাৎ এবং ডিসিসিভ বা পূর্বপরিকল্পিত দুই ধরনের। এর মধ্যে ডিসিসিভ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিরোধযোগ্য। তাই যারা ডিসিসিভ আত্মহননের চেষ্টা করে তারা বিভিন্ন সময়ে নিজের আচরণে তা আগেই প্রকাশ করে থাকেন এবং স্পষ্ট কিছু ইঙ্গিত প্রদান করেন। আর সেটা যদি শনাক্ত করা যায় তবে অনেক ক্ষেত্রেই আত্মহত্যার চেষ্টা নিবৃত করা যায়। যেমন- ডিসিসিভ আক্রান্তরা বন্ধুদের কাছে অথবা সামাজিক মাধ্যমে তাদের এই ইচ্ছের বিষয়টা প্রকাশ করে। হঠাৎ করে নিজেকে গুটিয়ে ফেলে এবং একা থাকতে শুরু করে। অতিরিক্ত ঘুমায় নয়তো সারারাত জেগে থাকে। অযৌক্তিক তর্ক করে। হতাশা থেকে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে এবং নিজের ক্ষতির চেষ্টা করে।

তাই উপরোক্ত লক্ষণগুলো দেখা মাত্র আমাদের সচেতন হতে হবে। কারণ, একটি আত্মহত্যা শুধুমাত্র যে একটি অমূল্য জীবনের অপচয় তা নয়; একই সাথে তার পরিবারিক, আর্থিক ও সামাজিক বিপর্যয় এবং তা প্রতিরোধের একমাত্র উপায় সচেতনতা। আর তার জন্য চাই মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন। কারণ, মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, যখন কোনো ব্যক্তির জ্ঞান, বিবেক-বুদ্ধি, উপলব্ধি ও অনুধাবন শক্তি লোপ পায় তখন সে নিজেকে অসহায় মনে করেন এবং সবকিছু ভুলে আত্মহত্যা করে বসেন। অতিরিক্ত মানসিক পীড়নও এর একটি অন্যতম কারণ। তাছাড়া দুঃখ-কষ্ট, লাঞ্ছনা ও অপমান থেকে বাঁচতেও অনেকে আত্মহননের মাধ্যমে মুক্তির পথ খোঁজেন।

তাই মানসিক সক্ষমতা বাড়াতে এবং সকলের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও ক্লিনিক্যাল সাইক্লোজিস্ট এর সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং মনোবিজ্ঞানীদের সহায়তায় স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। আত্মহত্যার প্রবণতা আছে এমন ব্যক্তির সার্বক্ষণিক খোঁজ-খবর নিতে হবে। তাকে যথেষ্ট সময় দিতে হবে ও তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। সর্বোপরি আত্মহত্যা প্রতিরোধে ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। তার জন্য কিছু ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কঠোর আইনি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। কারণ, অনেক ক্ষেত্রেই আত্মহননের পেছনে প্রয়োজনীয় সামগ্রীর সহজলভ্যতাকে দায়ী করা হয়। তাই খোলা বাজারে কীটনাশক এবং চিকিৎসাপত্র ছাড়া ঘুমের ঔষুধ বিক্রি সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। আত্মহত্যার পেছনের কারণ সমূহ চিহ্নিত করে গণ সচেতনতা তৈরি সচেতন করতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ১৫-২৪ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীদের আত্মহত্যার প্রধান কারণ হতাশা। আর এই হতাশা বা মানসিক বিপর্যয় হলো মাদক সেবনের অন্যতম একটি কারণ। যার ফলে মাদক সেবীদের আত্মহত্যার ঝুঁকি সাধারণের থেকে প্রায় ১০ গুণ বেশি। আর যারা ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক সেবন করে তাদের ঝুঁকি প্রায় ১৪ গুণ বেশি এবং ২৭ থেকে ৯০ শতাংশ এরও বেশি আত্মহত্যার কারণ মানসিক সমস্যা। তবে আত্মহত্যা প্রতিরোধ এবং শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে পরিবারের বিকল্প নেই। কারণ, শিশুকে মানসিক ভাবে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে এবং বয়োঃসন্ধি কালের আত্মহত্যার প্রবণতা কমাতে ছোট থেকেই মা-বাবার আন্তরিক সাহচার্য প্রয়োজন।

লেখক: শাহীন আলম
শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক,
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপৌনে ৫ লাখ পরীক্ষার্থীর বিসিএস নিয়ে আতঙ্কে আছি: স্বাস্থ্য সচিব
পরবর্তী নিবন্ধ৪১তম বিসিএসের রিট খারিজ, ১৯ মার্চই পরীক্ষা