আকাশ সংস্কৃতি নৈতিকতা অবক্ষয়ের প্যারাসাইট

শাহীন আলম
শুক্রবার, ১২ মার্চ ২০২১ | ২:২৩ অপরাহ্ণ
গল্পটি রূপকথার নয়

একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বায়নের যুগে আকাশ সংস্কৃতির কৃষ্ণ ধূম্রকুঞ্জে ছেয়ে গেছে সমগ্র দেশ। পাশ্চাত্য অপসংস্কৃতির আগ্রাসন আর বিদেশি ভোগপ্রবণ স্থূলতার ভীড়ে হারিয়ে যেতে বসেছে আমাদের নিজস্ব লোকসংস্কৃতি। মস্তিষ্কের সূক্ষ্ম নিউরনে ক্রমশ মরণফাঁদের জটিল সংক্রমণ ঘটাচ্ছে আকাশ সংস্কৃতির এই প্যারাসাইট। আধুনিকতার উন্মেষ হিসেবে আখ্যায়িত করে একে সমর্থন দিচ্ছেন আমাদেরই তথাকথিত একশ্রেণির খুচরো বুদ্ধিভিত্তিক সম্প্রদায়। আর সেই সুযোগে অনুপ্রবেশ ঘটছে অসুন্দর, কলুষিত ও আদর্শভ্রষ্ট ভাড়াটে সংস্কৃতির। নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে অপসৃত হওয়ার ফলাফল হিসেবে নৈতিকতাবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে তরুণ প্রজন্ম। স্বকীয়তা হারিয়ে শ্রীহীন সংস্কৃতির উদ্ভট জোয়ারে শিকড়বিহীন কচুরীপানার মতো ভেসে চলছে তারা। নৈতিকতা বিবর্জিত হয়ে একপ্রকার অনুরক্ত ভৃত্যে পরিণত হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে মানসিক বিকারগস্ত, নেতৃত্ব গুণহীন, মেধাহীন একটি সম্প্রদায়। বাড়ছে ধর্ষণ, খুন, অপহরণ, ইভটিজিং, ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ।

প্রযুক্তির সহজলভ্যতায় স্যাটেলাইট আর ক্যাবলে বন্দী হয়ে যাচ্ছে যাপিত জীবনের ভাবনা। লোকসংস্কৃতির জায়গা দখল করে নিচ্ছে বিদেশি জৈবিক পরিতুষ্টির অশ্লীল চলচ্চিত্র ও বিকৃত রুচির নাচ-গান। বোম্বের যৌন সংস্কৃতির প্রদর্শনী আজ ড্রয়িংরুমের প্রতিটি বোকা বাক্স। প্রযুক্তির এই সহজলভ্যতার কারণে ইন্টারনেট ও পর্নোগ্রাফি আসক্ত হয়ে উন্নত দেশগুলোর ১২-১৬ বছর বয়সী যুবাদের প্রায় ৬২ শতাংশ যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের মতো বড় অপরাধে জড়িয়ে পরছে। এক জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে ৩০ জন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীর মধ্যে ক্লাসরুমে বসে পর্নোগ্রাফি দেখে এমন ২৫ জনের মোবাইল ফোনে পর্নোগ্রাফি পাওয়া যায় এবং ১০০ জন অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীর ৮৬ জন মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। যাদের মধ্যে ৭৬ জন পর্নোগ্রাফি দেখে। পরিসংখ্যান বলছে, ইন্টারনেটের মোট তথ্যভান্ডারের প্রায় ২৫ শতাংশই পর্নোগ্রাফি এবং ২০ কোটির অধিক ওয়েবসাইটের মধ্যে ৫ কোটি পর্নোগ্রাফি সম্পর্কিত।

আকাশ সংস্কৃতি নৈতিকতা অবক্ষয়ের প্যারাসাইট

উনিশ শতকে আমাদের দেশে যে উদ্দাম অপসংস্কৃতির যাত্রা শুরু হয়েছিল তখনই তার লাগাম টেনে না ধরায় আজ অপসংস্কৃতির বেসাতি হয়ে উঠছে বাংলাদেশ। অনাচার ও উচ্ছৃংখলতার আগ্রাসনে নৈতিকতাবোধ ক্রমহ্রাসমান। মোহগ্রস্ত আবেগ তাড়িত তরুণ প্রজন্মের অনেকেই ইতোমধ্যে জীবনের বিকল্প ভাবতে শুরু করেছে প্রযুক্তি তথা আকাশ সংস্কৃতিকে। যতটা প্রয়োজন তার থেকে বেশী সময় ব্যয় করছে ভার্চুয়াল জগতে। এডাল্ট ফিল্টারিং সিস্টেম না থাকায় নিষিদ্ধ সাইটে অপ্রাপ্ত বয়স্কদের অনুপ্রবেশ হয়ে উঠছে অপ্রতিরোধ্য। ধর্মনিষ্ঠা ও নৈতিকতাবিচ্ছিন্ন হয়ে বিলাস বাগাড়ম্বর, সংশয়বাদী, উন্নাসিক চটকদার আকাশ সংস্কৃতিতে তরুণ প্রজন্মের সিংহভাগ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাচ্ছে। বাউল, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি কিংবা গম্ভীরা গানের সুরে তাল না মিলিয়ে বার অথবা ডিজে পার্টির অ্যালকোহলিক আড্ডায় তারা মত্ত।

তাই আকাশ সংস্কৃতির লাগাম টেনে ধরার এখনই উপযুক্ত সময়। কেননা আমরা চাই তরুণ প্রজন্ম আন্ডার ওয়ার্ল্ডের মহারথী বা মাদকাসক্ত নয়; দেশের সম্পদ হোক। তাই পাশবিক চিন্তাধারার বিদেশি ভোগবাদী সংস্কৃতির নীলনকশার বাস্তবায়ন ঠেকাতে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে তথ্য ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে। সকল অনুঘটকের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করতে হবে পরিবার এবং সমাজের প্রতিটি সদস্যকে। দোদুল্যমান সংস্কৃতির অবসান ঘটিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত পুনরুজ্জীবন ঘটাতে হবে লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্যকে। তার জন্য চাই যথাযথ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা। তবেই মৌলবাদের জুজুর ভয় আমাদের থাকবে না। মনন আর ললিতকলার সুতীব্র প্লাবনে ক্রান্তিকালে নিপতিত হবে আকাশ সংস্কৃতির নৈতিকতা অবক্ষয়ের প্যারাসাইট।

লেখক: শাহীন আলম, সাংবাদিক ও শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে শঙ্কা
পরবর্তী নিবন্ধকরোনায় আরও ১৩ মৃত্যু, শনাক্ত ১০৬৬